![সাতক্ষীরায় দাবদাহে মরছে ঘেরের চিংড়ি](uploads/2024/05/06/satkhira-1714980522.jpg)
সাদা স্বর্ণের রাজধানীখ্যাত সাতক্ষীরায় চিংড়ি উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে প্রচণ্ড দাবদাহ ও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক হারে মারা যাচ্ছে বাগদা চিংড়ি। উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে চিংড়ি চাষে এমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার অধিকাংশ চাষি।
জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, ভাইরাসের পাশাপাশি প্রচণ্ড দাবদাহ, পর্যাপ্ত পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে ঘেরের বাগদা চিংড়ি মরছে। তার ওপর চাষিরা মৎস্য বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ না করায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি মৎস্য বিভাগের।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৯ হাজার লবণ-পানির ঘের রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। আর জেলার মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়। তবে এ বছর প্রায় ঘেরের বাগদা চিংড়ি মরে যাচ্ছে। এতে জেলার চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
স্থানীয় মৎস্য চাষিরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর তাপমাত্রা অনেক বেশি। এপ্রিল থেকে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে জেলা। হয়নি কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। ফলে লবণ-পানির ঘেরগুলোতে লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ঘেরের চিংড়িতে মড়ক লেগেছে। চাষিরা নতুন করে আর চিংড়ির পোনা ছাড়ছেন না। সবার মাঝে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনাবৃষ্টি আর প্রখর রোদে মাছের ঘের আর ছোট-বড় জলাশয়গুলোতে পানি কমে গেছে। অত্যধিক তাপে পানি উত্তপ্ত হয়ে ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যাচ্ছে চিংড়ি মাছ। শ্যামনগর উপজেলার গুমানতলী এলাকার চিংড়ি চাষি ইব্রাহিম খলিল জানান, ২০১২ সাল থেকে তিনি বাগদা চিংড়ির চাষ করেন। এবারও ১০ বিঘা লবণ-পানির ঘেরে ৪৫ হাজার বাগদার পোনা ছেড়েছেন। এখন প্রতিটি বাগদার ওজন ৪০ গ্রাম করে হয়েছে। কিন্তু তীব্র এই গরমে বাগদায় মড়ক লেগে সব মারা যাচ্ছে। তার ভাষায়, মৎস্যঘেরে পর্যাপ্ত পানি রয়েছে। নিয়মিত পরিচর্যার কোনো ত্রুটিও রাখেননি। কিন্তু তীব্র দাবদাহের কারণে কোনো হিসাব-নিকাশ মিলছে না।
একই এলাকার রাজু আহম্মেদ বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ২০০ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছি। প্রথম কোটার অবমুক্ত করা বাগদা মাছ মরে গেছে। এতে আমার ৩ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।’ প্রচণ্ড গরম, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ অনাবৃষ্টির কারণে তার মতো এ অঞ্চলের প্রায় সব মৎস্যঘেরের একই দশা। এলাকার বেশির ভাগ ঘেরে পর্যাপ্ত পানি নেই।
পোড়াকাটলা গ্রামের জয়ন্ত মণ্ডল জানান, চলতি মৌসুমে ১০ লাখ টাকা ঋণ করে ৫০ বিঘা জমিতে বাগদার চাষ করেন। চিংড়ি বিক্রি করে এপ্রিল মাসের ভেতর ঋণের টাকা উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু দাবদাহের কারণে মাছে মোড়ক লেগেছে। প্রতিদিন মাছ মারা যাচ্ছে। হঠাৎ মাছ মরার কারণে তিনি এখন পর্যন্ত ১ লাখ টাকার মাছও বিক্রি করতে পারেননি।
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার হান্নান সরদার বলেন, ‘বছরের শুরুতে ঘেরে বাগদার পোনা ছেড়েছি। সেগুলো বিক্রির উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। তবে হঠাৎ করে দুই সপ্তাহ আগে থেকে ঘেরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। আর যেসব জীবিত মাছ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর শরীরও দুর্বল। মাছ লালচে হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ভোরে আমার মতো অন্য ঘেরে একাধিক শ্রমিক কাজ করেন। তারা সবাই মরা মাছ তোলেন এবং একই সঙ্গে যতটা সম্ভব জীবিত মাছ ধরে নিয়ে বাজারজাত করেন। দাবদাহের কারণে মাছে মড়ক লাগায় ব্যবসায়ীরা চাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছেন। ইচ্ছামতো দামে মাছ কিনছেন ব্যবসায়ীরা। আর চাষিরাও উপায়ন্তর না পেয়ে নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের দেওয়া দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরায় দেশে বাগদা ও গলদা চিংড়ির এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হয়। তবে এখানে মাছের ঘের সনাতন পদ্ধতির। বেশির ভাগ ঘেরে পানির গভীরতা দেড় থেকে দুই ফুটের বেশি নয়। এ জন্য গ্রীষ্মকালে ঘেরে পানির স্বল্পতা, অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে মাছ মরার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধিসহ ঘের প্রস্তুত ও ভাইরাসমুক্ত পোনা ছাড়তে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাগদা চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর লবণসহিষ্ণু মাত্রা হলো সর্বোচ্চ ২৫ পার্টস পার থাউস্যান্ড (পিপিটি)। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি চিংড়ি চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, তা ঘেরগুলোতে নেই। এ কারণে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে গরমের কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। চাষিরা মৎস্য বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ না করায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।