![বকেয়া ভ্যাট আদায়ে ৫ হাজার কোটি টাকা পেল এনবিআর](uploads/2024/06/26/NBR-Petrobangla-1719385027.jpg)
অবশেষে ফাইল চালাচালি আর বৈঠকের পর বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছ থেকে বকেয়া ভ্যাটের ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
পেট্রোবাংলার কাছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কবাবদ বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এনবিআরের। বকেয়া ভ্যাট আদায় নিয়ে বিপাকে আছে এনবিআর। বছরের পর বছর চেষ্টা করেও আদায় হয়নি। এবারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এনবিআরের দায় মিটাল পেট্রোবাংলা।
কয়েক দফা পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে দাবিনামা ও চিঠি পাঠায় এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। কিন্তু কোনোভাবেই তা আদায় হয়নি। প্রতিবারই পেট্রোবাংলা বলেছে, তাদের কাছে কোনো টাকা নেই। ফলে এনবিআরের দাবি করা ভ্যাট পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সর্বশেষ এক মাস আগে অর্থসচিব, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে নিয়ে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে এনবিআরের বকেয়া আদায় নিয়ে কথা হয়। সে সময়ে সিদ্ধান্ত হয়, বকেয়ার ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দায় পরিশোধ করে।
বৈঠকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া পরিশোধের ক্ষমতা নেই। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে অ্যাডজাস্টমেন্ট (সমন্বয়) করার জন্য অনুরোধ করেছি। এনবিআর কর্তৃপক্ষ যে স্থিতির (ব্যাংক) কথা বলছে, আসলে বর্তমানে আমাদের হিসাবে জমা টাকা নেই। যা ছিল এলএনজি খাতে বিনিয়োগে ব্যয় হয়েছে। এখন বরং আমাদের বিভিন্ন বিল সরকার থেকে এনে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে এনবিআর দাবি করে, পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ স্থিতি অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া তারা প্রতিবছর মুনাফাও করছে। যা দিয়ে বকেয়া পরিশোধ সম্ভব।
সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬০১ কোটি ৪ লাখ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, পেট্রোবাংলা একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ভ্যাট আইন অনুসারে তাদের বারবার দাবিনামা ও তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি বকেয়া রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া কী করতে পারি, তাদের ব্যাংক হিসাব তো আমরা ফ্রিজ করতে পারি না। তবে বহু বৈঠকের পর এবারে কিছু আদায় হয়েছে। আশাকরি এবারে ধাপে ধাপে আদায় হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলার কাছে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত শুল্ককর বকেয়া পড়েছে ৫ হাজার ৬২৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আইন লঙ্ঘন করায় রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের কাছে এই বকেয়া জমা পড়েছে। দেখা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত পেন্ডিং বিল অব এন্ট্রির সংখ্যা ৫৯টি, যাতে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দুটি পেন্ডিং বিল অব এন্ট্রিতে বকেয়া ১২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১৪টি বিল অব এন্ট্রিতে ৭৫৮ কোটি ৮ লাখ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৯৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, মার্চে পাঁচটিতে ২৩২ কোটি ৮১ লাখ টাকা, মে মাসে ১০টিতে ৪৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, জুনে ১৫টিতে ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, জুলাইয়ে একটিতে ৪৭ কোটি ৩ লাখ টাকা ও আগস্টে ১০টি বিল অব এন্ট্রিতে বকেয়া ৭৭১ কোটি ১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যেসব আইজিএমের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি, এমন আইজিএমের সংখ্যা ৩৫টি। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ হিসাব করা হয় প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এভাবে কয়েক ধাপে বকেয়া বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রমতে, এ পর্যন্ত কাস্টম হাউস থেকে পেট্রোবাংলাকে ১০ বার চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া টেলিফোনে একাধিকবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বকেয়া পরিশোধ করেনি পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ। বহুবার আমদানিকারক পেট্রোবাংলাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়, কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। বিভিন্ন সময়ে চিঠি দেওয়া হয়, যাতে বলা হয়, বকেয়া পরিশোধ ও আইনের পরিপালন করা না হলে কাস্টমস আইন ও ভ্যাট আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের বিন লক, পণ্য খালাস বন্ধ ও ব্যাংক হিসাবের লেনদেন কার্যক্রম অপরিচালন করা হবে। এরপরও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বকেয়া পরিশোধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে পেট্রোবাংলা থেকে চিঠির মাধ্যমে কাস্টম হাউসকে জানায়, অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকি প্রাপ্তি সাপেক্ষে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে বকেয়া শুল্ককর পরিশোধ করা হবে।
কাস্টম হাউসের চিঠিতে বলা হয়, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে এই পণ্যের ‘রিকন্সিলাশন’ ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারি দপ্তরের আইন নিয়মনীতি পরিপালনে দায়িত্বশীল হওয়া সমীচীন। রাজস্ব পরিশোধে এনবিআর থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলাকে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি আইজিএমের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করেই পণ্যের হোম কনজাম্পশন কাস্টমস আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সে জন্য নির্ধারিত সময়ে বিল অব এন্ট্রি দাখিল ও কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য পেট্রোবাংলাকে বাধ্য করতে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা যেতে পারে বলে কাস্টম হাউস মনে করে। পাশাপাশি বকেয়া আদায়ে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার বিষয়েও এনবিআরের দিকনির্দেশনা কামনা করা হয় চিঠিতে।