![মানিকগঞ্জে কাঁচা মরিচের ফলনে বিপর্যয়, দুশ্চিন্তায় চাষিরা](uploads/2024/06/26/Manikganj-Green-Chilli-1719387481.jpg)
চার থেকে পাঁচ কেজি বড়জোর ১০ কেজি করে কাঁচা মরিচ আড়তে নিয়ে আসছেন চাষিরা। তাদের সংখ্যা যে খুব বেশি তাও না। অথচ এ সময়ে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা হাটে চাষিদের আনাগোনা থাকে সবচেয়ে বেশি, মরিচের সরবরাহও হয় প্রচুর। তবে এবারের মৌসুমে এ অঞ্চলে মরিচের ফলনে নানা কারণে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যার কারণে মরিচের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর ও শিবালয় উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে অন্য উপজেলার চেয়ে বেশি মরিচ আবাদ হয়। এ অঞ্চলের মরিচ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারেও রপ্তানি হয়ে থাকে। ভালো ফলনের আশায় গত বছরের তুলনায় মানিকগঞ্জে এবার ১৭৬ হেক্টর বেশি জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। তবে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় রিমাল ও পাতা কুঁকড়ানো রোগের কারণে মরিচের ফলন কমেছে তিন চতুর্থাংশ। এমন অবস্থায় উৎপাদন খরচ উঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে মানিকগঞ্জে ৩ হাজার ৭১৭ হেক্টর জমিতে কাঁচা মরিচের আবাদ হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ১৭৬ হেক্টর বেশি। প্রতি বছর এখানকার উৎপাদিত মরিচ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। দুই বছর আগেও এ অঞ্চল থেকে শত কোটি টাকার মরিচ বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। প্রচণ্ড গরম ও সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় এই ফলন বিপর্যয় বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের বাস্তা গ্রামের মরিচচাষি রহমান ব্যাপারী তার মরিচখেত দেখিয়ে বলেন, ‘প্রথমে তীব্র খরায় অধিকাংশ মরিচ গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়। কয়েক বার সেচ দেওয়ার পর কিছুটা ভালো হয়। তার দুই সপ্তাহ পর আবার তীব্র খরায় একই অবস্থা হয়। পরে ঘূর্ণিঝড়ে অনেক গাছ মরে গেছে। তবে যে গাছগুলো আছে তাতে ফুল এলেও মরিচ ধরছে না। এ পর্যন্ত আমার জমির মরিচগাছ থেকে এক মণ মরিচও তুলতে পারি নাই।’
উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মরিচচাষি আলী হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলে মরিচ খুব ভালো হয়। যার জন্য ভালো ফলনের আশায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে মরিচের আবাদ করি। আবাদের জন্য কয়েকজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিই। কিন্তু এমন ফলন বিপর্যয়ে সব কৃষকের মাথায় হাত। বিঘা বিঘা মরিচগাছ পাতা কুঁকড়ানো রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছের মাথা থুবরে গেছে। শুধু আমার অবস্থাই এমন না আশপাশের সব কৃষকের একই অবস্থা।’
পার্শ্ববর্তী শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়নের বরংগাইল গ্রামের কৃষক শাজাহান। দুই বিঘা জমিতে মরিচের আবাদ করতে চারা, সার, কীটনাশক, সেচসহ খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এই সময়ে প্রতিদিন জমি থেকে দুই আড়াই মণ মরিচ হওয়ার কথা থাকলেও ফলন বিপর্যয়ের কারণে প্রতিদিন দুই কেজিও মিলছে না। সার, কীটনাশক, সেচ দিয়েও সুফল পাননি তিনি।
চাষিরা বলছেন, মরিচ উৎপাদনের ভরা এ মৌসুমে ফলন বিপর্যয়ের কারণে বাজারে খুব অল্প মরিচ উঠছে। এর প্রভাবে গত বছরের মতো এবারও কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে চলছে। বিভিন্ন আড়তে মানভেদে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গাছ থেকে কাঁচা মরিচ তোলার কাজ করেন বীথি আক্তার। পড়াশোনার পাশাপাশি তার মতো কয়েক শ মানুষ এই মৌসুমে এ কাজ করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের মতো এ বছরও মরিচের ফলন বিপর্যয়ের কারণে অনেক নারীশ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আমরা খেত থেকে যত কেজি মরিচ তুলব তার বিনিময়ে টাকা পাব। আগে গাছে হাত দিলেই মরিচ পাওয়া যেত আর এখন খুঁজে খুঁজে মরিচ ছিঁড়তে হয়। তাই অনেক নারীশ্রমিক এখন আর এ কাজ করেন না।’
হরিরামপুরের ঝিটকা বাজারের আড়তদার মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘স্বাভাবিক ফলন হলে এই সময়ে আমার আড়তে কমপক্ষে ২০ হাজার কেজি কাঁচা মরিচ বেচাকেনা হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফলন বিপর্যয়ের কারণে বর্তমানে আমি ৫ হাজার কেজি মরিচ কিনতে পারিনি। এ সময় মরিচের দামও সাধারণত ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু বাজারে প্রতিকেজি মরিচের দাম এখনো ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলার অন্যতম মরিচের বড় আড়ত হরিরামপুরের ঝিটকা বাজার। এ আড়ত থেকেই প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কেজি মরিচ বিক্রি হয়। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকার মতো। এ সময়ে প্রতিদিন এই হাটে ১০ ট্রাক মরিচ কেনাবেচা হওয়ার কথা। কিন্তু এখন ৩ থেকে ৪ ট্রাক মরিচ দেশের নানা প্রান্তে যাচ্ছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. রবীআহ নুর আহমেদ বলেন, ‘সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় এই ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া মাসব্যাপী তীব্র তাপপ্রবাহ ও রিমালের কারণে মানিকগঞ্জের মরিচ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর পাতা কুঁকড়ানো রোগের সমাধানের জন্য বগুড়ার মসলা গবেষণাকেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি। তারা এ বিষয়ে আমাদের যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন তা কৃষকদের জানানো হয়েছে। যেহেতু বছরে একাধিকবার মরিচের আবাদ করা হয়, তাই আবহাওয়া অনুকূলে এলে কৃষকরা আগের মতো ফলন পাবেন।’