![শুল্ক ফাঁকি বন্ধে আধুনিক স্ক্যানিং মেশিন বসাবে চট্টগ্রাম কাস্টম](uploads/2024/06/26/CTG-Custom-1719387238.jpg)
রপ্তানি পণ্যের চালান শতভাগ স্ক্যান হয়ে কনটেইনার জাহাজে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। এর আগে স্ক্যানিং ছাড়া কায়িক পরীক্ষার মাধ্যমে পাঠানো হতো রপ্তানি পণ্যের চালান। এতে বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির সুযোগ নিত রপ্তানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান। এবার কায়িক পরীক্ষাসহ শতভাগ স্ক্যানিং হয়ে যাবে রপ্তানির প্রত্যেকটি কনটেইনার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উদ্যোগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস বন্দরের গেটে বসাচ্ছে চারটি নতুন স্ক্যানার মেশিন। এর মধ্যে দুটি প্রতিস্থাপন করে বসানো হবে, দুটি বসবে নতুন স্থানে। আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির দুটি স্ক্যানার ব্যবহার হবে শুধু রপ্তানি পণ্যচালানের কাজে।
কাস্টমস হাউসের সূত্র মতে, সরকার রপ্তানি খাতের উপ-খাত ভেদে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু রপ্তানিকারকরা কোনো ধরনের পণ্য রপ্তানি না করে ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে প্রণোদনার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস এবং কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের রিপোর্টে খালি কনটেইনার কিংবা পণ্য কম রপ্তানি করে অর্থপাচারের ঘটনা উঠে এসেছে। জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রপ্তানি পণ্যচালানের জন্য দুটি স্ক্যানার স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে উচ্চ প্রণোদনার সব রপ্তানি পণ্য চালান স্ক্যান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাস্টমস হাউস। অন্য দুটি স্ক্যানার পুরোনো দুটি বাদ দিয়ে ওই স্থানে বসানো হবে।
চীন থেকে আধুনিক মানের এ চারটি স্ক্যানার মেশিন আনা হচ্ছে। আগামী জুলাই মাসের যেকোনো সময় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে স্থাপন করা হবে স্ক্যানার চারটি।
আধুনিক প্রযুক্তির স্ক্যানারগুলো এক্স-রে বা গামা-রশ্মি ইমেজিং প্রক্রিয়ায় কনটেইনার খোলা ছাড়াই এর ভেতরের রঙিন ছবি তুলতে পারবে। এসব মেশিনে স্ক্যানার ছাড়াও কনটেইনারের ওজন পরিমাপ, রেডিও পোর্টাল মনিটর এবং ইমেজিং সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত থাকে। নতুন স্ক্যানারগুলো ‘বোথ ওয়ে’ স্ক্যান ডিরেকশনে স্ক্যানিং করতে সক্ষম। অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানি উভয় কনটেইনার এই স্ক্যানিং মেশিনে করা যাবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টমস শতভাগ রপ্তানি কটেইনার স্ক্যানের আওতায় নিয়ে এলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। গুটিকয়েক অসাধু মানুষের দায় তখন আর ঢালাওভাবে সবার ওপর আসবে না।’
রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যানারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছোটখাটো কিছু ত্রুটি ধরে রপ্তানি প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে। এতে রপ্তানি আয় কমার পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও রপ্তানিকারক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ডিপোতে কাস্টমসের জনবল বৃদ্ধি করে রপ্তানিকাজে আরও গতি বাড়াতে হবে।’
চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্পের আওতায় অঘোষিত ও বিস্ফোরকজাতীয় পণ্য আমদানির পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করা হয়।
আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি পণ্য স্ক্যানিং করে খালাস করা হলে কোনো আমদানিকারক এক পণ্য এনে অন্য পণ্য ঘোষণা দিয়ে বিদেশে অর্থপাচার করতে পারবেন না। আবার বেশি দামের পণ্য এনে কম দামের পণ্য হিসেবে অথবা উচ্চ শুল্ককরের পণ্য আমদানি করে বিনা শুল্ক অথবা কম শুল্কের পণ্য হিসেবে ছাড়াতে পারবেন না। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি অর্থ পাচারও কমবে। অস্ত্র, গোলাবরুদ কিংবা বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য এনে কেউ খালাস করতে পারবেন না।
বর্তমানে বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ১ নম্বর গেট এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ৩ নম্বর গেটে আছে অত্যাধুনিক ফিক্সড কনটেইনার স্ক্যানার। চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ২, ৪ ও ৫ নম্বর গেটে আছে একটি করে ফিক্সড কনটেইনার স্ক্যানার। অপরদিকে সিসিটি-২ ও জিসিবি-২ নম্বর গেটে রয়েছে একটি করে মোবাইল স্ক্যানার। চীনের নাকটেক কোম্পানি লিমিটেড থেকে স্ক্যানারগুলো কেনা হচ্ছে। স্ক্যানার মেশিনগুলো বন্দরের ৪ নম্বর গেট, সিসিটি-২, এনসিটি-২ ও ৫ নম্বর গেটে বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে জানা গেছে।
এদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩০০ কোটি টাকা অর্থপাচারের রহস্য উন্মোচন করে কাস্টমস গোয়েন্দা। সংস্থাটি জানায়, ঢাকার সাতটি, গাজীপুরের দুটি ও সাভারের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, পানামাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করেছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্ক্যানের নামে রপ্তানিকারকরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সেটি দেখতে হবে। আমরাও চাই মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি না হোক অথবা পণ্য চালানের আড়ালে অর্থপাচারের মতো ঘটনা ঘটুক। আমরাও বন্দর, কাস্টমসকে সব সময় সহযোগিতা করার মনমানসিকতা রাখি। আমরা আশা করছি, নতুন স্ক্যানার মেশিনগুলোর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলো শতভাগ স্ক্যান ছাড়া পণ্য নিতে চায় না। আধুনিক স্ক্যানার মেশিন সংযোজনের ফলে ‘আন্তর্জাতিক জাহাজ এবং বন্দর সুবিধা নিরাপত্তা’ (আইএসপিএস) কোডের শর্ত পালনে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে চট্টগ্রাম বন্দর।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. ফাইজুর রহমান বলেন, ‘সরকার রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান এর অপব্যবহার করেছে। তারা জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই আমরা এবার রপ্তানি পণ্যকে শতভাগ স্ক্যানিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যেগ নিয়েছি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসকে আধুনিক চারটি স্ক্যানার দিচ্ছে। এর মধ্যে দুটি প্রতিস্থাপন করা হবে, দুটি দিয়ে রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যানিং করা হবে।’