![প্রতিবাদী কবি অসীম সাহা](uploads/2024/06/21/Osim-Shaha-1718950836.jpg)
কবিতায়, লেখালেখিতে, জীবনাচরণে তিনি ছিলেন শুদ্ধতাবাদী, প্রতিবাদী। শিক্ষা, মননের গভীরতা, পরিচ্ছন্ন রুচির শৈল্পিক স্বপ্নমেদুর প্রতিফলন রয়েছে তার রচনাসম্ভারে। এই ব্যক্তিত্বের নাম অসীম সাহা। গত ১৮ জুন ২০২৪ অনন্তলোকের পথে যাত্রা করলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তার মৃত্যুতে খবরের কাগজ পরিবার গভীরভাবে শোকাহত।
স্পষ্টবাদী এই মানুষটি ছিলেন স্রোতের বিরুদ্ধযাত্রী। সেটা তার জবানীতেই আমরা জানতে পারি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নীতির প্রশ্নে আপস করতে পারিনি বলে ৫৮ বছরে ২৬টি চাকরি ছেড়েছি। জীবনে অনেক ক্রান্তিকাল কাটিয়েছি। ঢাকা শহরে দিনের পর দিন পরিবার নিয়ে উপোস করেছি। কিন্তু কোথাও মাথা নত করিনি। আমি সব সময় মনে করেছি, বিবেক বিক্রি করে, নিজের সততা থেকে সরে গিয়ে কিংবা আমার আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। আমার এই অবস্থান থেকে আমি একচুলও নড়িনি।’
অসীম সাহা ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৯ সালে পান দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক। আরও পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতি। পেশা ছিল সাংবাদিকতা। এক মেয়াদে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রগতিশীল ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কবি অসীম সাহা।
কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, সংগীত রচনা, গবেষণা, অনুবাদ-সাহিত্যের নানা শাখায় ছিল এই কবি লেখকের স্বচ্ছন্দ ও অবাধ বিচরণ। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে রয়েছে: আবৃত্তির প্রেমের কবিতা, অসীম সাহার সেরা কবিতা, প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা, কবিতা-টবিতা নিয়ে কিছু কথা, লেখালেখির এলোমেলো নামতাপাঠ, অসীম সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা, তোমারে কমু না, সংস্কৃতি রূপে অরূপে, অসীম সাহার ১০০ কবিতা, কিলের চোটে কাঁঠাল পাকে, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ, রাইসোনা ও মোটু-পাতলুর ছড়া, অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব, শ্মশানঘাটের মাটি, বর্ণহীন বেদনা, পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়, মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি, তাক ধিনা ধিন ধিনা, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাঙালির মুক্তি, পাঁজর ভাঙার শব্দ, কবর খুঁড়ছে ইমাম, উদ্বাস্তু, কালো পালকের নিচে, হেনরি ডিরোজিও, আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধান, চিরায়ত কিশোর কবিতা, হিরো মামার গোয়েন্দাগিরি, প্রেম পদাবলি, শেয়ালের ডিগবাজি, মুহূর্তের কবিতা, চরম গরম ছড়া, উদাসীন দিন, অক্টাভিও পাজ ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা, ম বর্ণের শোভিত মুকুট, চেতনার জাগরণে বই, আপন ঘরে উইপোকা, সৌর-রামায়ণ, পুরনো দিনের ঘাসফুল, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত ইত্যাদি।
অসীম সাহার জন্ম ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনায়। পৈতৃক বাস মাদারীপুর। ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে স্নাতক পাস করে সেই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পিছিয়ে যায় এবং তিনি ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ (২০১৪)’ চলচ্চিত্রে তিনি গান লিখেছেন, সেই গানে তার দেওয়া সুরে গেয়েছেন শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ—‘কৃষ্ণ দরশনে রাধা কদমতলে যায়’। কিশোর বয়সে লেখালেখির হাতেখড়ি। ১৯৬৪ সালে যখন ছিলেন এসএসসির ছাত্র, তখন প্রথম একটি অনুকৃত কবিতা লেখেন। এরপর ১৯৬৫ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু। সংস্কৃত কবি জয়দেব গোস্বামীর ‘গীতগোবিন্দ’-এর ১৪ সর্গের সহজ কাব্যিক অনুবাদ করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে: শুধু নারীবাচক শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ‘নারী অভিধান’ সংকলন ও সম্পাদনা, সনাতনধর্মীদের ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীগীতা’র সবচেয়ে সহজ বাংলা অনুবাদ।
সবশেষে কবি অসীম সাহার কবিতা
এনজিওগ্রাম
বাইপাস দিয়ে নতুন রাস্তা ধরে ছুটে যেতে আমার খুব ভালো লাগে!
কিন্তু তার জন্যে সংযোগ-সড়ক চাই-
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এরকম ভাবতে-ভাবতে
যখন জানলাম, সংকীর্ণ পথের শেষপ্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে
রক্তকণিকার জমাটবাঁধা কিছু কেয়াকাঁটার ঝাড়-
তখন তাকে অপসারিত করার জন্য সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর মতো
যখন একা একা খুব দ্রুতবেগে ছুটে গেলো
স্প্রিংয়ের কেমিক্যালসজ্জিত কিছু স্বয়ংক্রিয় তার-
আমার চোখে নেমে এলো অসমাপ্ত ঘুম!
ঘুম ভাঙলে জানতে পারলাম, এরই মধ্যে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটে গেছে
কোলাহলমুখরিত হৃদয়ের আন্তরপ্রদেশে;!
২.৭৫ সেন্টিমিটার আকারের অপ্রতিরোধ্য ট্যাংকও তাকে
প্রতিহত করতে পারেনি কোথাও!
অন্ধকার রাত্রির বাইপাস পার হয়ে অবদমিত একটি হৃদয় শুধু ছুটে গেছে
মাধবীলতার বনে, অসংবৃত সুন্দরের কাছে!
বেসরকারি গ্রামে গ্রামে আগুনের হলকায় সরে গেছে
মৃত্যুর বাইপাসে ধাবমান আর একখানি তরল হৃদয়!!