![শহিদজননী জাহানারা ইমাম এবং একাত্তরের দিনগুলি](uploads/2024/06/21/Jahanara-Imam-1718950623.jpg)
১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে জাহানারা ইমাম একাত্মতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মৃত্যু, দুঃস্বপ্নভরা বিভীষিকার মধ্যে তার ত্যাগ ও সতর্ক সক্রিয়তা দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ উদাহরণ হয়ে আছে। শহিদ রুমীর মা পরিণত হন শহিদজননীতে। মুক্তিযুদ্ধে সন্তান বিয়োগের বেদনাবিধুর মাতৃহৃদয় এবং যাতনা মূর্ত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির উত্থানে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তার পটভূমিতে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হলে তিনি আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলন পরিচালনা করেন। তারই নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় গণ-আদালত।...
শহিদজননী হিসেবে অধিক পরিচিত জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য নাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও তার বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে বাংলাদেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জাহানারা ইমামের জন্ম অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সদরপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩ মে। পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আব্দুল আলী ও মাতা সৈয়দা হামিদা আলী। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী শরীফ ইমাম, জাহানারা ইমামকে পড়ালেখায় উৎসাহ জোগান। ১৯৪৫ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সানডিয়াগো স্টেট কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে ‘সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস হাইস্কুলে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে চাকরি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। খেলাধুলা, নাটক, সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন সমিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘খাওয়াতীন’ নামে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ‘দৈনিক বাংলা’য় কলাম লিখতেন। পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন।
কৃতী নারী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকের ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মহলে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য ছিলেন সুপরিচিত। সংস্কৃতিককর্মী হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে পৌঁছে দিয়েছেন তার অধীত জ্ঞানসম্ভার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী রুমী তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেছে নিলে তিনি তাকে অনুপ্রেরণা জোগান ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোপনে সাহায্য করে চলেন যোদ্ধাদের। যুদ্ধে রুমী ধরা পড়লেও তার আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ও তার স্বামী ক্ষমা চাইতে রাজি হননি ঘাতকদের কাছে। তিনি এই যুদ্ধ চলাকালে রচনা করেন তার বিখ্যাত দিনলিপি, যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ (১৯৮৬) নামে প্রকাশিত হয় এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত জাহানারা ইমামের বই সমগ্র পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে, এর একটি বড় কারণ হলো তার রচনার হৃদয়গ্রাহীতা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, জাহানারা ইমামের ‘অন্যজীবন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “...নিউইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এসেছেন। আমার খুব ইচ্ছে তার সঙ্গে একটু পরিচিত হই। যখন তার আশপাশে কেউ নেই তখন কুণ্ঠিতভাবে তার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার বড় ভাই হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাহানারা ইমাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমাকেও চিনি। আমি তোমার বইও পড়েছি- তারপর তিনি আমার বই নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। শহিদ জননীর কথাগুলো আমার জীবনে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম আমার লেখা কেউ পড়ুক আর নাই পড়ুক আমি এখন থেকে নিয়মিত লিখে যাব।... আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধের ওপর বইটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললাম কিছু একটা লিখে দিতে। তিনি বইটির জন্য খুব সুন্দর কয়টি কথা লিখে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই কথাগুলো পিছনের মলাটে লিখে যখন বইটি প্রকাশিত হল, তখন আমার মনে হল সেই লেখাটি আমার জন্যে অনেক বড় সম্মান, সেই বইটি আমার জীবনের খুব বড় একটি সম্পদ। আজ আমি শহিদ জননীর ‘অন্যজীবন’ বইটির ভূমিকা লিখতে বসেছি। আমি কি কাউকে বোঝাতে পারব এটি আমার জন্যে কতো বড় সম্মান?”...
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অসামান্য। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালে তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় সমর্থনে গড়ে তোলেন গণ আদালত। জাহানারা ইমামের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘গজকচ্ছপ (শিশুতোষ, ১৯৬৭)’, ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি (শিশুতোষ, ১৯৭৩)’, ‘অন্য জীবন’ (১৯৮৫), ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ (১৯৯১), ‘প্রবাসের দিনলিপি’ (১৯৯২) ইত্যাদি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৮৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৯০), ‘স্বাধীনতা পদক’ (১৯৯৭), ‘বেগম রোকেয়া পদক’ (১৯৯৮) ও ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ (২০০১)। তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মিশিগানে।
জাহানারা ইমাম শুধু একজন লেখিকা বা শিক্ষাবিদ নন, যদিও দীর্ঘ সময় তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে ব্যয় করেছেন এবং বহু দেশ ঘুরেছেন। তার বড় পরিচয় বিধৃত রয়েছে সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের ভেতর, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আপসহীন কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মিছিলে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার অনিবার্য উপস্থিতি ব্যক্তি হিসেবে তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।