ঢাকা ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

ছায়া গাছ

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
আপডেট: ২১ জুন ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
ছায়া গাছ
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ট্রেনটা সচল হতেই তপেশের ফোন এলো, ‘কী দাদা, কতদূর?’
আর বোলো না, ‘ব্যারাকপুর ছাড়লাম সবে।’ 
‘এসো, আমি অপেক্ষা করছি।’ 
তপেশরঞ্জন এক সময়ে লটারির টিকিট বিক্রি করত। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। এখন মস্ত বড় প্রমোটার হয়েছে। 
ট্রেনটা ভালোই গতি নিয়েছে। শতানিক জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছে। কত মাঠ-ঘাট, জনবসতি পেরিয়ে যাচ্ছে। কেমন ঘুরে ঘুরে দূর থেকে কাছে চলে আসছে আবার কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে।

এমনি বুঝি হয়। এখন বড় হয়ে বুঝেছে। কাছের মানুষেরা কেমন দূরে সরে সরে গেছে। আর দূরের যারা যাদের কখনো চিনত না জানত না, তারাই এখন কাছের মানুষ হয়ে গেছে। জীবনটা যেন এক চলমান রেলগাড়ি। 

যদুনাথপুরে শতানিকদের বাড়ি। সত্তর বছরের বাসিন্দা ওরা। এবারে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলবে ঠিক করেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও কেটে গেল পনেরোটা বছর। মা থাকাকালীন তবু যোগাযোগ ছিল। 

নিতাই কাকাই বাড়িটার দেখভাল করে। প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে আছে। এ বাড়ির সদস্যই বলা যায়। দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অনেক আশ্রিতের দলে নিতাই কাকাও ছিল। 
চাকদা নেমে একটা অটোতে চেপে বসল। 

অটো যেই চলতে শুরু করেছে অমনি পুরান স্মৃতিরা সব হুড়মুড়িয়ে চলে এল। একটা সময়ে এই রাস্তা হাতের তালুর মতো চেনা ছিল। 
প্রতিটা মোড়, কোন বাড়ির সামনে কী ফুল গাছ ছিল, কী রঙের ফুল ফুটত, কোন বাড়ির মেয়েটা খুব সুন্দরী, কোন স্যারের কাছে টিউশন পড়ে ইত্যাদি সমস্ত নাড়িনক্ষত্র জানা ছিল। 

অটোতে বসে কত কিছু ভাবছিল শতানিক। কিছুদিন ধরেই ভাবছে বিষয়-সম্পত্তি সব গুটিয়ে নেবে। বয়েস বাড়ছে, এসব দেখভাল করার সময় কোথায়। মাঝে মাঝে নিতাই কাকার সঙ্গে কথাবার্তা হয়। নিতাই কাকা এতদিন ছিল, তাই রক্ষে। তবু আশপাশের মানুষ প্রায় দিন ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। এই তো সেদিন অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতেই নিতাইকাকার ফোন, ‘সতুবাবা পাশের বাড়ির সমর বিস্তর গোল পাকাচ্ছে।’

‘কেন?’ 
‘তোমাগের মধু কুলকুলি আম গাছের এট্টা ডাল ওগের দিকে ঝুঁকে পড়ায় উঠোন নোংরা করতিছে।’   
‘ঠিক আছে, ডালটা কেটেই দাও।’ 
‘তা দিচ্ছি বাপ, তুমি যখন কচ্চ, কিন্তু ওই ডালটাতে মেলা আমের কুষি আসিছে। কেমন মায়া করতিছে ডাল কাটতি। তার ওপর আর এক ফ্যাকড়া তুলিছে।’ 
‘কী?’  
‘ওগের টিনির চালে ঝুনো নারকেল পড়ায় ওগের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতিছে।’ 
শতানিক খানিক মাথা চুলকে বলল, ‘তুমি এবারে এক কাজ করো, ঝুনো নারকোল সব বিক্রি করে দাও। পরের বারে ডাব বিক্রি করে দিও, কেমন? এসব উটকো পাটকা ঝামেলা আর সহ্য হয় না।’

নিতাই কাকা ফোনের ও প্রান্তে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লেন বোঝা গেল। এই গাছপালা নিয়েই রোজগার ঝামেলা লেগেই আছে। আসলে নিতাই কাকা আর কাকিমা বহুদিন ধরে ওই বাড়িতে আছে, এতটা জমি-বাগান দেখভাল করছে এটা অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। এটা শতানিক বুঝতে পারছে। তারাই আবার তপেশকে লাগিয়েছে, জায়গাটা কেনার জন্য। 

তপেশ সেদিন এমন সময়ে ফোন করেছিল যখন ও অফিসের জরুরি একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল। 
আস্তে করে বলল, ‘রাতে কথা বলব’। 
সেদিন রাতে ফিরে তপেশের কাছে ফোন করেছিল। তপেশ বলল, ‘কী করবে দাদা ওই জায়গা-জমি রেখে? তোমরা তো আর কোনোদিন এসব জায়গায় আসবেও না। তার চাইতে কত দাম নেবা বলো আমি কিনে নিই।’
শতানিক বলল, ‘একটু সময় দাও। হুট করে বলতে পারছি না।’  
‘সে তুমি সময় নাও, তবে বেচবে মনস্থির করলে আমাকে জানাবে কিন্তু।’ 
‘ঠিক আছে।’ 
সে মাস ছয় সাত হবে। সেদিন হঠাৎ আবার তপেশের ফোন, ‘কী দাদা, কিছু ভাবলে?’ 
‘নাহ, কিছুই ভাবিনি।’  
‘ভাব, এরপরে জবরদখল হয়ে গেলে কি ভালো লাগবে?’ 
তপেশের কথার ভিতরে অন্য এক সুর শতানিকের কানে নতুন অর্থ বয়ে আনল। 
শতানিক বলল, ‘দু-এক দিন সময় দাও’।

রাতে শতানিক মিসেসের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করলে মহুল বলল, ‘ঠিকই বলেছে, আজকাল তো দেখছি কিছুদিন পড়ে থাকলেই সব ক্লাব দখল করে নিচ্ছে। কিছুই বিশ্বাস নেই। মা-বাবা যতদিন ছিলেন সে এক রকম ছিল। দেখ...’।

শতানিক অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল- ওই বাড়ি এবং সংলগ্ন এক বিঘের ওপরে বাগান, সব বিক্রি করেই দেবে। এর ভিতরে পাড়ার দু-চারজনের কাছ থেকে শুনে নিল কেমন জমির দাম। 

যাই হোক বাড়ি আর জায়গা মিলে একটা দাম বলল শতানিক। তপেশ তার ওপরে একটু দরাদরি করল।  শতানিক বুঝতে পারল, জমির দাম এর চাইতেও বেশি। ও ভুল করে অনেক কম চেয়ে ফেলেছে। এক কথায় রাজি হয়ে গেলে শতানিক বুঝতে পারবে ভেবে নিয়ে তাই এই ঝোলাঝুলি।

শেষমেশ ওর কথাতেই রাজি হয়ে গেল। বাড়িসংলগ্ন জমি মিলে চল্লিশ লাখ রফা হলো। সামনের সপ্তাহে বাড়িতে যাবে শতানিক জানিয়ে দিল। ওইদিনই ফাইনাল করে দেবে। তপেশ দশ লাখ অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে দেবে বলেছে। বাকিটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে। 

তপেশ বলল, তোমাদের বাড়িতে যারা থাকে তাদের বলে দিও, এর ভিতরে অন্যত্র সরে যেতে।
সে আমি দেখছি, তোমার কিছু বলার দরকার নেই।
আজ প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে নিতাই কাকা ওদের বাড়িতে আছেন। 

শতানিক পড়তে চলে এলে এই কাকা-কাকিমাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভাল করতেন। ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্র কেনা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজকর্ম এমনকি এই বাড়িটার দায়দায়িত্ব সব কিছুই এই নিতাই কাকা আর কাকিমাই পালন করেছেন। নিতাই কাকা ছিলেন বলেই না শতানিক শান্তিতে পড়াশোনা, চাকরি, পরবর্তীতে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পেরেছে। 
অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে শতানিক এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

এদিকে এলেই মনটা অকারণে কেমন ভালো হয়ে যায়। পুরনো মানুষগুলো প্রায় কেউই নেই, নতুন নতুন মুখ সব, তবু যেন ভালো লাগে। সেই বটতলা, প্রাইমারি স্কুল, সেই খেলার মাঠ, যে মাঠে বিকেল হলেই দাপিয়ে বেড়াত। বর্ষায় চোরকাঁটা আর কাদা মেখে বাড়িতে ফিরত। সে একটা সময় ছিল। কথাটা মনে পড়তেই একটা খরগোশ বুকের ভিতরে লাফিয়ে চলে গেল। 
বাড়িতে পা দিতেই নিতাই কাকা এগিয়ে এল, ‘এসো বাবা, সেই কখন বেরিয়েছ।’ 
‘ঘরে ঢুকতেই ফ্যান চালিয়ে দিল।’ 

শতানিক ওদের প্রধান ঘরে ঢুকে বসল। কী সুন্দর পরিপাটি করে রেখেছে। ঠিক আগের মতোই। শোকেসের ওপরে বাবার সেই ফটোটা এখনো জ্বল জ্বল করছে। ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল। কোনো কিছুই সরানো হয়নি। বরঞ্চ প্রতিটা জিনিস খুব যত্ন করে মুছে গুছিয়ে রেখেছে নিতাই কাকা। ও ঘুরে ঘুরে পাশের প্রতিটা ঘর দেখল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দোতলার ঘরগুলো সব ঘুরে ঘুরে দেখল। বাবা যে ঘরে ছাত্র পড়াতেন সেই ঘরটা, সেই চেয়ারটা আজও তেমনি আছে। তক্তপোষের ওপরে একটা লাল-নীল ডোরাকাটা শতরঞ্চি পাতা আছে। এমনি একটা শতরঞ্চিতে ছাত্ররা বসত। মনে পড়ল বহুকাল আগের সেই কথা। বাবা চার্লস ডিকেন্স, অস্কার ওয়াইল্ড, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, শেলি, কিটস, বায়রন পড়াতেন। ও চুপটি করে পড়া শুনত। 

নিচেয় এসে দেখল নিতাই কাকা ডাব হাতে রেডি, ‘খাও বাবা’ বলে এগিয়ে দিল। 
বাড়ির গাছের ডাব, কী মিষ্টি এবং সুস্বাদু।   
ও এক নিঃশ্বাসে জলটুকু খেয়ে মস্ত বড় একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল।

এরপর বাগানে এল। কত গাছগাছালিতে ভরা এই বাগান। বাবা আর মায়ের হাতের সব স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। কী সুন্দর ছায়াঘন পরিবেশ। কত পাখি গাছের ডালে। কুটুর কুটুর, চিকচিক, কিচিরমিচির সুরে ডাকছে। গরমের দিনে এই আম কাঁঠাল লিচু সবেদা বাগানে মাদুর পেতে শতানিক বই পড়ত। ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করত। তখন এখনকার মতো এমন প্রতিযোগিতা ছিল না। অনেকটা সময় ছিল ইচ্ছেমতো সময় কাটানোর। 

এ বাড়িতে কত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন বাবা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে আত্মীয়-অনাত্মীয় মানুষ একটুখানি আশ্রয়ের জন্য তখন হন্যে হয়ে ঘুরতেন। এই বাড়িতে দু-চার বছর কাটিয়ে তারা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত। বাবাই ছিলেন এ দেশে তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। 
সেই সময় থেকে নিতাই কাকা এ বাড়িতে। তারপর কত যুগ পেরিয়ে গেল। 

বাড়িটার কিছু কিছু জায়গায় প্লাস্টার খসে হাড় পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। শতানিকের মনে পড়ে, বাবা নিতাই কাকাকে বলতেন, আমরা যখন থাকব না নিতাই তুই কিন্তু এই গাছগাছালি আর এই বাড়িটার যত্ন করিস। এই বাড়িটা ছিল বাবার কাছে মায়া নিকেতন। বাবা বলতেন, বাড়ি যেমন মানুষের আশ্রয়স্থল, ঠিক তেমনি সেই বাড়িটা যখন জীর্ণ হবে তখন সে অন্যের সাহায্য চায়। একটু আশ্রয় দাবি করে। তারও তখন যত্নের প্রয়োজন। 

শতানিক বলল, ‘কাকা আমাকে একটু বেরোতে হবে।’ 
নিতাইকাকা ঘরের ভিতরে নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করছিল। 

শতানিক দুপুরে খেতে এসে দেখল নিতাইকাকার জিনিসপত্র সব কিছু বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। 
দুপুরে খাওয়ার পরে সোজা ছাদে উঠে চারপাশটা দেখতে লাগল। কেমন ছায়ায় ঘেরা এই মায়াকুঞ্জ। 
কাছেই আমগাছের পাতার আড়ালে একটা ইস্টিকুটুম পাখি ডাকছিল। হলুদ রঙের লাজুক পাখিটা ডেকেই পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। শতানিক ভাবছে, বাড়িটা বিক্রি করে দিলে এই গাছগুলো সব কাটা পড়বে, এই পাখিগুলো আশ্রয়হীন হবে। সেই সঙ্গে নিতাই কাকাও। বাবার এই ‘মায়া নিকেতন’ চিরতরে হারিয়ে যাবে। মুছে যাবে বাবা-মায়ের সব রকম স্মৃতিচিহ্ন। 
কথাগুলো ভাবতেই বুকের ভিতরে একটা কান্না গুমড়ে উঠল। 
এখনো এই বাড়িতে পা রাখলে মনে হয় বাবা আছে, হয়তো বাইরে গেছে। এখনি এসে পড়বে।
মা হয়তো ধারেকাছে আছে কোথাও।

ঠিক তখনি হলুদ পাখিটা ডেকে উঠল, ‘কুটুম হোক। খোকা হোক।’ 
শতানিক খুঁজছে পাখিটাকে। পাখিটা কী করে জানল, সামনেই পাপানের বিয়ে? নতুন কুটুম তো আসছেই।
বিকেল গড়িয়ে গেছে। নিচে এসে দেখল নিতাই কাকা জিনিসপত্র ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে। 
শতানিকের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘সতুবাবা, এই নাও চাবি।’ 
নিতাই কাকার গলার স্বর কেঁপে উঠল, হাত কাঁপছে থরথর করে। 
শতানিক হাতটা বাড়িয়েও কাছে টেনে বলল, ‘চ-চাবি? চাবি কী করব আমি?’ 
‘আমি তো আর এ বাড়িতে থাকতিছি না।’ 
‘মানে, কোথায়  যাচ্ছ?’
‘যাই দেখি। তপেশ যে বলল এ বাড়ি ছেড়ে দিতে। তুমি নাকি বেচে দেছ?’ 
‘তাই বলেছে বুঝি?’
কথার ভিতরে শতানিক দেখল তপেশ এক মুখ হাসি নিয়ে এদিকে আসছে।
বলল, ‘তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে শুনলাম। আমি একটু বিশেষ কাজে বেরিয়েছিলাম। 
অ্যাডভান্সের টাকাটা কি নগদে নেবে নাকি চেক দেব?’ 
শতানিক কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘বুঝলে তপেশ, আমি এ বাড়ি বেচব না।’  
‘বেচবে না? কেন?’ 
‘আমার ছেলে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।’  
শেষের কথাটা হঠাৎই কে যেন ওকে দিয়ে বলিয়ে নিল। 
তপেশ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে শতানিককে। এইটুকুর সময়ের ভিতরে পুরো এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল কীরকম? 
গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, যা ভালো বোঝো।’  
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এল। এবারে বেরোতে হবে।
নিতাইকাকার চোখে জল। আবার কবে আসবা বাবা? 
খুব তাড়াতাড়িই। 

ভ্যান চলতে শুরু করেছে। বেশ কিছুটা চলার পরে সোজা রাস্তাটা বায়ে বাঁক নিলে শতানিক ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকাল। দেখল, নিতাই কাকা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন এক ছায়াগাছ। এতকাল যিনি নিজেই আশ্রিত ছিলেন আজ মনে হলো তিনিই এখন বাড়িটার একমাত্র আশ্রয়স্থল। 

কথাটা ভাবতেই শতানিকের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৮ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৪০ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

কী ব্যাপার এত রাতে জেগে আছ যে- খাবার খেলে না? শরীর খারাপ কি? 
স্ত্রীর কথায় দত্ত বাবু বললেন, না ঠিক আছি, আচ্ছা শোন, তুমি তো সাবিনা নামের প্যাসেন্টটাকে দেখেছ? কী মনে হয় তোমার? 
গাইনোকলজিষ্ট স্ত্রী বললেন- বারকয়েক দেখেছি। ভেবেছিও। ও রকম একটা ছোট্ট মেয়ের ওপর যে টরচার হয়েছে তাতে ওর বেঁচে থাকাই কঠিন। কিন্তু সে বেঁচে আছে! 

কিন্তু জানিনে কীভাবে তা সম্ভব? তোমার কী মনে হয়? ওকে কি নরমাল লাইফ দেওয়া সম্ভব হবে? 
ভেরি ডিফিকাল্ট। শুনলাম, জ্ঞান ফিরলে আবারও ফেইন্ট হচ্ছে। রক্তপাত বন্ধ করা যাচ্ছে না। জেনিটাল অরগানগুলো টোটালি ড্যামেজ্ড। আগে জেনারেল হেল্থটাকে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করা যাক, পরে না হয় সার্জারির কথা ভাবতে পার। কিন্তু আগরতলায় সে রকম প্লাস্টিক সার্জন পাবে কোথায়? 

সবই জানি, কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জটা নিতে চাই স্বপ্না। কী নিঃষ্পাপ ফুলের মতন ফুটফুটে মেয়ে, ঠিক আমাদের মেয়ের মতন!
স্বামীর মুখ দেখে ওর মনটাকে বোঝবার চেষ্টা করে স্ত্রী। বলে- দেখ চেষ্টা করে- আমিও থাকব তোমাদের সঙ্গে। 

গভীর রাতে ডাক্তার দত্ত ও তার স্ত্রী যখন কথা বলছিলেন ঠিক তখনই বর্ডারের ওপার থেকে রাইফেল-মেশিনগানের কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল। একই মাটি, একই আলো-বাতাস, ভাগ হয়েছে দুই দেশের সীমানায়। আগরতলায় বসে পূর্ববঙ্গের গাছে বসা পাখির গান শোনা যায়, মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাঠে কৃষকের গান, ট্রেন চলার শব্দ- সব কানে আসে। অতএব, আগ্নেয়াস্ত্রের লাগাতার শব্দ রাতের শহর আগরতলাকে কাঁপিয়ে তুলল। এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে আতঙ্কিত মেয়ে দেবলীনা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কামান দাগার বিকট আওয়াজ হতেই দেবলীনা মাকে ছেড়ে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ডাক্তার দত্ত বললেন- ওপারে যুদ্ধ চলছে মা, আমাদের ভয়ের কিছু নেই। 

কিন্তু আমার ভয় করে বাবা। ভীষণ ভয় করে। কিছুই ভালো লাগে না। 
শরণার্থী সংকট ও যুদ্ধের কারণে দেবলীনাদের স্কুল বন্ধ। সারা দিন শুয়ে-বসে থাকতে হয়। আগের মতো বন্ধুরা কেউ আসে না, সেও যেতে পারে না কোথাও। এভাবে সময় কাটাতে তার একদম ভালো লাগে না। 

সে রাতেই আগরতলা এয়ারপোর্টের কাছে কামানের গোলা পড়ল কয়েকটা। বিকট শব্দে কুঞ্জবনে রথীন দত্তের বাড়িটাই কেবল কেঁপে উঠল না গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালও কেঁপে উঠল। ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়াল। সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। সাবিনার মা পারভীন আক্তার নিজেও সৈন্যদের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সপ্তাহ কয়েক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কাছাকাছি কোথাও কামানের গোলা পড়ায় তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। অনেক কষ্টে পা ফেলে মেয়ের বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভয়ে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সাবিনা। মা কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ওই যে মিলিটারি আসছে মা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। 

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন পারভীন আক্তার। আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন- ভয় পাস না মা- এটা ইন্ডিয়া, আরেক দেশ, জল্লাদেরা এদিকে আসবে না। 

কিন্তু সাবিনার আর্তচিৎকার থামানো গেল না। সে কাঁপতে থাকল। নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা টেনে খুলে ফেলল। কোমরের নিচের নলগুলো খোলার চেষ্টা করল। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে পারভীন আক্তার চিৎকার করে নার্স ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দুজন নার্স দৌড়ে এল। এসেই একজন শক্তি দিয়ে সাবিনাকে চেপে ধরল, অন্যজন নাকমুখের নলগুলো লাগিয়ে দিতে দিতে বলল- এ রকম করলে কী চলে! লক্ষ্মী মেয়ে, প্লিজ, তুমি চুপ করে থাক। এখানে কোনো ভয় নেই তোমার। আমরা আছি তো। 

৫. 
৫ আগস্ট ১৯৬৫ সাল। নতুন উত্তেজনা শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আকস্মিকভাবে তার ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ শুরু করলেন। হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনা রাতারাতি ঢুকে পড়ল জম্মু ও কাশ্মীরে। ভারতের হাত থেকে কাশ্মীর মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বিপাকে পড়লেন। হুকুম দিলেন ভারতের সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণের। ৫ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর- চলল সাত সপ্তাহের ভয়ংকর যুদ্ধ। মারা গেল দুই দেশের হাজারো সেনা। ধ্বংস হলো ঘরবাড়ি, স্থাপনা। 

সে যুদ্ধে ভারত পূর্ব ফ্রন্টে যুদ্ধ চালায়নি। যদি আক্রমণ হতো তাহলে কী ছিল পূর্ব অংশের প্রতিরক্ষা দেওয়ার? কিছুই নেই! আত্মরক্ষার যা কিছু সবই পশ্চিম পাকিস্তানে! অতএব, শক্ত অবস্থান নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান: কেবল অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু নয়, সামরিক দিক দিয়েও অরক্ষিত রাখা হয়েছে বাংলাকে। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার।

৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল। পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয় দফা দাবি পেশ করলেন। প্রথমত লাহোরে- পরে ঢাকায় ফিরে বিস্তারিতভাবে। পূর্ব বাংলাসহ প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। প্যারামিলিটারি রাখার অধিকার দিতে হবে। বিদেশ বাণিজ্যের অধিকার থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ব্যয় হবে। অতএব, মোড় ঘুরে গেল পাকিস্তানি রাজনীতির। ছয় দফার স্লোগানে কাঁপতে থাকল পূর্ব পাকিস্তান, জেগে উঠতে থাকল বাঙালি। বিপরীতে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল সামরিক জান্তার। দিন যত যেতে লাগল, ধর্মের বর্ম-পরা গণবিরোধী শাসকচক্রের চোখে পাকিস্তানি অখণ্ডতার পয়লা নম্বরের দুশমন হয়ে উঠলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। শুরু হলো লাগাতার নিপীড়ন, জেলজুলুম। প্রথমত, হেনস্থার কূটকৌশল আঁটা হলো; দ্বিতীয়ত, চলল স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্তব্ধ করার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র। 

শেখ মুজিবুর রহমান এবং কিছু বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা কি সত্যি সত্যি ভারতের সাহায্য নিয়ে হাজার মাইল দূরের উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি দাসত্ব হঠাতে চেয়েছিলেন? চাইলেও চাইতে পারেন, আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি শেখ মুজিব, গ্রহণযোগ্য কোনো গবেষণাও হয়নি। তবে আগরতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের একবারের আগমন নিয়ে রাজ্যের সেদিনকার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের একটি স্মৃতিচারণ আছে। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

কারবালা উপাখ্যান: ইতিহাসের রক্তক্ষরণ কিংবা শিল্প ও সত্যের যাপন

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
কারবালা উপাখ্যান: ইতিহাসের রক্তক্ষরণ কিংবা শিল্প ও সত্যের যাপন

খেলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনা মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে বিধৃত ও স্বীকৃত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই প্রতারণামূরক যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত এখনো বিদ্যমান। মুসলিম বিশ্ব এখনো দ্বিধাবিভক্ত। এখনো ওই ঘটনা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যথিত ও কাতর হন। 

প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল লিখলেন নতুন উপন্যাস কারবালা উপাখ্যান।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ লেখা হয়েছে। ফিকশন, নন-ফিকশন, ইতিহাস, গজল, মর্শিয়া, আখ্যান আরও নানা ধরনের রচনা। ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানাভাবে। মুসলিম বিশ্ব এবং অমুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন প্রক্ষেপণে আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করেছে এই যুদ্ধের কারণ, গতিপ্রকৃতি এবং অভিঘাত। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো এই ঘটনা নিয়ে খোদ মুসলিম বিশ্বে এখনো দ্বিধা-বিভক্তি চলমান। রয়েছে অতিরঞ্জন। এসবের ভিড়ে মূল ইতিহাস এবং এর আসল প্রবাহ বের করা খুবই কঠিন।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে শত বছর আগে বাংলাভাষায় বিষাদ সিন্ধু নামে উপন্যাস লিখেছিলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। মুসলিম লেখকদের মধ্যে লেখা এ উপন্যাসটিকেই প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। বিপুল পঠিত ও সমাদৃত হয় এ উপন্যাস। এমনকি বাঙালি মুসলমান এই গ্রন্থটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবেও মর্যাদা দিয়ে এসেছে এর প্রকাশের পর থেকে আজ অব্দি। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক বাড়িতেই দেখা গেছে ধর্মীয় গন্থের সঙ্গে বিষাদ সিন্ধুর একত্র সমাবেশ।

প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে এসে এরকম একটি উপন্যাস লেখার উপযোগিতা কী? যে ঘটনা বহুশ্রুত, জ্ঞাত, উল্লিখিত, বর্ণিত, চর্চিত। সে-ঘটনা নিয়ে কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কেন নতুন করে আরেকটি উপন্যাস লিখতে বসলেন। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কারবালা উপাখ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। শুধু এর কাহিনি নিয়ে নয়, এর কাঠামো, ভাষা, উপস্থাপন নিয়ে কথা বলতে হবে। 

প্রথমে আমরা এর কাহিনির দিকে তাকাই। আমার সঙ্গে হয়তো-বা অনেকেই দ্বিমত করবেন না এই বিষয়ে যে, বর্তমান সময়ে আমরা এক ধরনের তথ্যের নৈরাজ্যের মধ্যে বসবাস করছি। একসময় আমাদের তথ্যের অপ্রতুলতা ছিল ব্যাপক। এরপর তথ্যের অপ্রতুলতা ঘুচলেও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপতথ্য। যুক্ত হয়েছে অর্ধসত্য। ফলে এখন চলেছে তথ্যের নৈরাজ্য। এখন কোনো তথ্য পাওয়ার পর সেটা ফ্যাক্টচেক না করে গ্রহণ করলে গোলমাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 

কারবালার ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়। কোন তথ্য ঠিক, কোনটা বেঠিক, কোনটা অর্ধসত্য, কোনটা অপতথ্য তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। কারণ একেক উৎসে একেক ধরনের তথ্য। এমনকি পরস্পর বৈপরীত্যও লক্ষ্যণীয় সেসব তথ্যে। কারবালার ঘটনা নিয়ে এরকম ঘটার কারণ হলো বিভিন্ন মতাদর্শ। বিভিন্ন ধরনের মত বা থিওরি প্রয়োগ করার জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তার অনুসারী বাড়ানোর জন্য ইচ্ছেমতো ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা করা হয় নিজেদের হীন স্বার্থে। এর মধ্য থেকে নির্ভেজাল ইতিহাস বের করে আনা সাধারণের পক্ষে কঠিন।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কঠোর পরিশ্রম করে নির্ভেজাল ইতিহাসের আলোকে লিখেছেন এ উপন্যাস। ফলে বলতেই পারি- সাধারণের পক্ষ্যে যা কঠিন লেখক তা সহজ করে দিয়েছেন। অপতথ্য আর অর্ধসত্যের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন এই সময়ে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা এ উপন্যাসকে তাই সময়ের সঠিক দিশারি বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কারবালা উপাখ্যানের কাঠামো, বর্ণনা ও ধারাবাহিকতা। এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের একটি বড় গুণ হলো আবেগ বিবর্জিত হওয়া। কিন্তু কারবালার ঘটনা এতই মর্মান্তিক যে, একজন মুসলমান হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত ও আবেগাপ্লুত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারবালার ঘটনা মূল ঘটনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার এটাও একটা কারণ। লেখকও তো মানুষ। কাজেই কারবালার ঘটনায় আবেগাপ্লুত হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এখানে খুব সংবরণের পরিচয় দিয়েছেন; যা কারবালা নিয়ে লিখতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকই ব্যর্থ হন। তারা ইতিহাসের অংশে আবেগ নিয়ে প্রবেশ করায় মূল জিনিস থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। মোস্তফা কামালের লেখকসত্তা এখানে ব্যক্তিসত্তাকে ছাপিয়ে গভীরতা ও সত্যসন্ধানী পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাতে কী হয়েছে? তাতে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে, অযাচিত আবেগের হাত থেকে উপন্যাসটি রক্ষা পেয়েছে। আর পেরেছে ইতিহাসগ্রন্থ না হয়ে উঠতে। হয়ে উঠেছে উপন্যাস।

ইতিহাস বিকৃতি থেকে মুক্ত হওয়া, তথ্যের বিকৃতি না করা, ইতিহাসের পরম্পরা থেকে হঠাৎ বিচ্যুত না করা, অহেতুক ভাবালুতায় আক্রান্ত না হওয়া এবং আবেগবর্জিত হওয়ার দরুণ কারবালা উপন্যাসের ভাষা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক তরতরে। আরও সহজ করে বললে বলতে হবে- একুশ শতকীয়। অর্থাৎ একুশ শতকীয় ভাষায় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের অন্তরে-বাহিরে ভ্রমণ করার সুযোগ।

শুধু তাই নয়, ওই সময়ের, ওই দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে রূপ তা এই সময়ে এই দেশের কাঠামোর অনুরূপ নয়। লেখক ঘটনার অভিঘাত ও পরম্পরা বোঝানোর জন্য ওই কাঠামোগুলো তাদের আদিরূপে দেখাননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আমরা যাদের আমাদের দেশের এই একুশ শতকীয় ভাষায় পুলিশ, গোয়েন্দা ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকি। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ওই সময়ের শৃঙ্খলা-কাঠামো বোঝাতে গিয়ে ওই সময়ের পদ-পদবি উল্লেখ করেননি। করেছেন এই সময়ের আলোকে। ফলে পাঠকের পক্ষে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রের গতিবিধি লক্ষ্য করে কার কী ক্ষমতা ও ভূমিকা তা সহজেই অনুধাবন করতে পারে। একটি উপন্যাসের সঙ্গে মনো-সংযোগের এই উপাদান মোস্তাফা কামাল খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন।

আবেগের অতিশয্য নেই, ভাষার কচকচানি নেই, ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার জন্য কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ নেই, কাউকে মহান বানানোর গোপন অভিসন্ধি নেই, কাউকে ছোট করার নির্লজ্জ অভিপ্রায় নেই। এরকম নির্মোহ হয়ে লিখেছেন মোস্তফা কামাল।

ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কিছু ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে যখন চরিত্রগুলো বাস্তব হয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি শুধুই সময় হয়ে থাকে, এবং শুধু সময়কে ধারণ করার অভিপ্রায় থেকে লেখক লিখতে চান তাহলে তার ঝুঁকি কম। সাধারণ চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে সময়ের অভিপ্রায় ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তার রেখে যাওয়া ছাপ ও অভিঘাত তুলে ধরার জন্য তিনি ইচ্ছেমতো কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে পারেন। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সময় অবধারিতভাবেই নির্দিষ্ট। আগের অবস্থায় চরিত্র ছিল অনির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক, সুপরিচিত, সুবিদিত এবং বহুল চর্চিত। এরকম চরিত্র নিয়ে, জানা ঘটনা নিয়ে, বহুল চর্চিত বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা সহজ কথা নয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের রচনার সবগুলো উপাদানই হলো নন-ফিকশনাল কিন্তু লেখক লিখতে বসেছেন ফিকশন। চরিত্রের প্রকৃত রূপ ঠিক রেখে এ ধরনের বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুঃসহ-ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে অনেক মেধার প্রয়োজন হয়।
 
লেখক মোস্তফা কামাল এই ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসহ কাজটি নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই গুরুদায়িত্ব তাঁকে দিয়ে যে মহান কাজটি করাল তাতে কয়েকটি কাজ সাধিত হলো। যেমন, বাংলা সাহিত্য একটি উপন্যাস পেল। যে উপন্যাসে তথ্যের কোনো নৈরাজ্য নেই, আবেগের বাহুল্যতা নেই, কাউকে বড়ো করে দেখানোার কপট মাহাত্ম্য নেই, কাউকে ছোট করে দেখানোর নির্লজ্জ কপটতা নেই, ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার গোপন অভিসন্ধি নেই, সর্বোপরি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে কপট ধর্ম প্রচার নেই। তিনি আসলে ফিকশন রচনা করতে চেয়েছেন। আর তাতে ইতিহাসের সত্য, যাপনের সত্য, চরিত্রের সত্য ও ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন ইসলামের এক নাজুক সময়কে। 

পাঠক যদি নির্ভেজাল তথ্যের আলোকে ওই সময়টাকে যাপন করতে চান, মর্মোদ্ধার করতে চান ওই সময়ের চরিত্রের, তাহলে এ উপন্যাসের সঙ্গে যাপন করতে পারেন। সে-যাপন শিল্প ও সত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে।

কারবালা উপাখ্যান
লেখক: মোস্তফা কামাল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মেধা রোশনান সারওয়ার
মূল্য: ৪৬০ টাকা

এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রাত সাড়ে ১০টার মতো হবে। গ্রামের বৃক্ষশোভিত পথ। সংকীর্ণ পাকা রাস্তা। রাস্তার দুধারে লাইটপোস্ট নেই বলে ঘন অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলে এতটা অন্ধকার হতো না। গ্রামে অটোরিকশা, মোটরবাইকের চলাচল ৯টার পরেই বন্ধ হয়ে যায়। যানবাহনহীন নির্জন পথটা কালো সাপের মতো শুয়ে আছে চুপচাপ। 

সেই রাস্তার নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ছিঁড়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিছিলেন থানার ওসি আরমান খন্দকার। সবাই তাকে ওসি আরমান বলে। সহযাত্রী হিসেবে তার মোটরবাইকের পেছনে বসেছিলেন তার সহকর্মী এসআই খবির। তারা বিরামপুর বাজারের দিকে আসছিলেন। অবশ্য থানায় যাওয়ার জন্য বাজারের আগেই ডান দিক দিয়ে একটা পথ বেরিয়ে গেছে। হয়তো তারা চা খেতে আসছিলেন। বিরামপুর বাজারে রাত সাড়ে ১০টা/১১টা পর্যন্ত চা পাওয়া যায়। আর এখানে রশীদ মিয়ার চায়ের সুনামও আছে। সেই সঙ্গে সবাই জানে ওসি আরমানের বেপোরোয়া চায়ের নেশার কথা। 

ওসি আরমান আর এসআই খবির গিয়েছিলেন শালপাতা গ্রামে সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে। রাত ৯টার ভেতর তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ওসি আরমান গল্পবাজ মানুষ। খাওয়ার পর গল্পসল্পে কেটে গেছে ঘণ্টাখানেক।

বাজারের ঠিক আগে আসতেই আচানক গাছের আড়াল থেকে কে যেন টালমাটাল পায়ে রাস্তায় বের হয়ে এল। সে গান গাইছে-
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে 
আমার পৃথিবী থেকে
আলোর পথে আর কেউ নেবে না
আমারে কখনো ডেকে।

ওসি আরমান আপ্রাণ চেষ্টায় দুর্ঘটনা এড়ালেন। আর একটু হলে মোটরবাইক নিয়ে পাশের খাদে চলে গিয়েছিলেন। বাইশ বছর ধরে মোটরবাইক চালাচ্ছেন। দক্ষ চালক বলেই সামলে নিতে পারলেন। 

এসআই খবির ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। লাঠি হাতে তেড়ে গেলেন টালমাটাল পায়ের যুবকের দিকে। ওসি আরমান তাকে নিরস্ত করলেন। বোঝা যাচ্ছে যুবকটা মাতাল। বর্তমানে তাড়িমদ খুব সহজ হয়ে গেছে। অন্যসব রকম মাদক ঠেকানো গেলেও তাড়িমদ ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ এগুলো বাড়িতেই তৈরি করা যায়। আর এ ধরনের মদ একটু বেশি খেলেই মদখোর বেশামাল হয়ে পড়ে। 

যুবকটা বলল- ওসি সাহেব, আমার নাম মনোয়ার হাসান। সবাই হাসান নামে চেনে। এই যে বাজারের লাগোয়া আমাদের বাড়ি। ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স শেষ করেছি এবার। 

সবাই তাকে হাসান নামে চিনলেও ওসি আরমান বা এসআই খবির তাকে চিনতে পারলেন না। তাদের চেনার কথাও না। ওসি আরমান বললেন- আপনি এভাবে অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছেন যে? আর একটু হলেই তো আমি দুর্ঘটনায় পড়তাম। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। 
ওসি আরমানের এ কথায় কান না দিয়ে হাসান বলল- মিলুর বিয়ের দাওয়াত থেকে এলেন ওসি সাহেব?

সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের নাম মিলু ওসি আরমান তা জানে। ওসি আরমান কিছু বলার আগেই এসআই কবির বললেন- আপনি তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। জানেন, আপনাকে আমরা এখন থানায় নিয়ে যেতে পারি?

-নিয়ে যান। আমাকে বেঁধে থানায় নিয়ে যান। কঠিন একটা মামলা দিয়ে আমাকে জেলে আটকে রাখেন। খুনের আসামি করে ফাঁসি দিতে পারলে আরও ভালো হয়। মানুষের জগৎ আমার আর ভালো লাগে না। মানুষের এই জগতে আছে শুধু স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস। এখানে প্রেমের নামে চলে সাপলুডু খেলা। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন?

মাতাল হলে লোকে নানারকম ভাবের কথা বলে। চাকরিসূত্রে ওসি আরমান আর এসআই খবিরের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে। হাসান ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স। 

সে কেন তাড়িমদ খেয়ে এরকম মাতলামি করছে? এ গ্রামে এরকম শিক্ষিত তো খুব বেশি নেই। ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব বাজারে আসেন। চা খেতে খেতে আপনার সঙ্গে কথা বলব। 
-কী বিষয়ে কথা বলবেন?
-কথা বলার বিষয় পাওয়া যাবে। 
-মিলুদের সঙ্গে কি আপনার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে?
-না, তা নেই। 
-তাহলে বিয়েতে দাওয়াত দিল যে? থানার ওসি, এসআইদের তো দাওয়াত দেয় যারা এলাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা। মিলুর বাপ সিদ্দিক ব্যাপারী তো সেরকম কেউ নন। 
-আমাকে দাওয়াত দেওয়ার কারণটা ভিন্ন।
-কী কারণ? 
-আমি তিনবার এই মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। চতুর্থবারের মাথায় তার বিয়ে সম্পন্ন হলো। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বড় চাকরি করে। তো তারা আমার কাছে কৃতজ্ঞ। আগে যেসব ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা এরকম যোগ্য ছিল না। তাদের স্ট্যাটাস অনেক নিচে ছিল। 
-চলেন বাজারে যাই। বাজারে গিয়ে চা খেতে খেতে কথা বলি।

ওসি আরমান বাইক টান দিয়ে রশিদ মিয়ার চায়ের দোকানে গেল। শত হলেও থানার ওসি। গ্রামের মানুষের কাছে ভয়ের এবং সম্মানের ব্যক্তি। উপস্থিত লোকজন দ্রুত সরে গিয়ে পুরো একটা বেঞ্চি খালি করে দিল। রশিদ মিয়া বলল- স্যার, কী চা খাইবেন, দুধ চা না লাল চা? দুধ চায়ে খাঁটি 
গরুর দুধ দিই। লাল চা যদি খান তো লেবু, আদা, পুদিনা পাতা আছে।
ওসি আরমান বললেন- একটু পরে, হাসান আসুক।
এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের চোখে-মুখে বিস্ময় জাগল। হাসানকে তারা সবাই চেনে। হাসানের সঙ্গে যে ওসি সাহেবের খাতির আছে তা কেউ জানত না। 

মিনিট সাতেকের মধ্যে হাসান এল। তার টালমাটাল অবস্থা কমেনি। হাসান এত রাতে তাড়িমদ খেয়ে হাঁটছে এ ব্যাপারটাও উপস্থিত লোকদের বিস্ময়ের কারণ হলো। শিক্ষিত-ভদ্র যুবক হিসেবেই তাকে সবাই চেনে। এলাকার অনেকের ছেলেমেয়েকে সে গণিত প্রাইভেট পড়ায়। সে তাড়িমদ খাবে একথা কেউ কল্পনাও করেনি। ওসি আরমান সরে গিয়ে হাসানকে বসতে দিলেন। হাসান বসলে ওসি আরমান বললেন- আমাদের তিনজনকে লাল চা দিন। 

লাল চায়ে চুমুক দিয়ে হাসান বলল- ওসি সাহেব, মূলত আপনি মিলুর বিয়ে ভাঙেননি। তিনবারই মিলুর বিয়ে ভেঙেছি আমি। সবাই ঝট করে তাকাল হাসানের মুখে। ভাবল, তাড়ির মাদকতায়ই হয়তো সে এমন কথা বলছে। তবে কণ্ঠ জড়ানো নয়, স্পষ্ট ও স্বাভাবিক। 
হাসান আবার বলল- ওসি সাহেব, তিনবারই কিন্তু ফোন গিয়েছিল যে, এই ঠিকানায় একটি বাল্যবিবাহ হতে যাচ্ছে। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। বিয়ে হলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। জাতি বঞ্চিত হবে একটি শিক্ষিত মা থেকে। 
ওসি আরমান বললেন- হু, তিনবারই ফোন পেয়ে আমি ফোর্স নিয়ে ছুটে এসেছিলাম। বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।

-ফোনগুলো কে করেছিল?
-দিন-তারিখ দিয়ে সব রেকর্ড করা আছে। দরকার হলে বের করতে পারব। দরকার বোধ করিনি।
-ফোনগুলো করেছিলাম আমি। তবে এবার আর পারলাম না। এবার সে প্রাপ্তবয়স্ক। অনার্স ফোর্থ সেমিস্টারে পড়ে। নিজের জীবন নিজেরই বোঝার সক্ষমতা রয়েছে। আমার ফোনে কোনো লাভ হতো না। থানা-পুলিশ আমার ফোনকে বিশেষ গুরুত্ব দিত না। 

ওসি আরমান বিষয়টা বুঝতে পারলেন। উপস্থিত অন্যরাও বুঝতে পারল। একটা ভালোবাসার নির্মম সমাপ্তি ঘটেছে। কেউ কিছু বলছিল না। কী আর বলবে? বলার মধ্যে হাসানকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলা যায়। এসব ক্ষেত্রে সান্ত্বনা খুব একটা কাজে আসে না। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। যুবকটা তাড়িমদ খেয়ে অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতটা কষ্ট তার বুকে বাজছে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

হাসান লম্বা একটা চা শেষ করে কাপটা নিঃশেষ করে কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল- অথচ মিলু বলেছিল, এতদিন তুমি আমার বিয়ে ভেঙেছ। এখন আর তোমাকে এই ঝুঁকিতে যেতে হবে না। বাবা যদি আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে তো আমিই ভেঙে দিতে পারব। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স আমার হয়েছে। তুমি ভারমুক্ত থাক, এবার একটা চাকরি জোগার কর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কী করল আমার জন্য? কথা কি রাখল?

কেউ কিছু বলল না। প্রেম-বিরহের গল্পগুলো সাধারণত একই রকম হয়। যার কষ্ট সে-ই শুধু বোঝে। একটু থেমে হাসান আবার বলল- মাত্র চার দিন আগেও মিলু আমার পাশাপাশি বসেছিল। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনেক কথা বলল। ঘুণাক্ষরেও আমি বুঝতে পারলাম না যে, মাত্র চার দিন পরই মিলু আরেকজনের বাসর আলোকিত করতে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য বলেন ওসি সাহেব!

ওসি আরমান পকেট থেকে একটা কয়েন বের করলেন। কয়েনটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে বললেন- এই যে কয়েন। কয়েনের দুটা দিক আছে। একটা হেড আরেকটা টেল। এর বেশি কিছু নেই। প্রেমেরও তাই। প্রেমে হয় বিরহ, নয় মিলন। জ্ঞানীরা বলেন, প্রেম বিরহেই অধিক উজ্জ্বল। বিরহেই প্রেমের সৌন্দর্য চির অমলিন। মিস্টার হাসান, মিলু আপনার হৃদয়ে চির অমলিন হয়ে থাকবে। শত চেষ্টা করলেও আপনি তাকে হৃদয় থেকে মুছতে পারবেন না। সে চলে গেছে অন্যের অধিকারে, তাই বলে আপনি কিন্তু তাকে ঘৃণাও করতে পারবেন না। সে আপনার চিরন্তন ভালোবাসা। ঠিক মিলুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে যত সুখ আর প্রাচুর্যের মধ্যেই সে থাক, তার মনের মণিকোঠায় আপনার জন্য একটু জায়গা শূন্য থাকবেই। কেউ সে শূন্যতা ভরাট করতে পারবে না।

হাসান মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব, আমি তাহলে...। 
হাসান মাথা তুলল। সবাই দেখল হাসান কাঁদছে। পুরুষ মানুষের নিঃশব্দ কান্নার ভেতর কতটা কষ্ট লুকিয়ে থাকে তা পুরুষমাত্রই উপলব্ধি করতে পারে। ওসি আরমান হাসানের কাঁধে, পিঠে হাত রাখলেন, আলত আঘাত করলেন, তারপর উঠে গেলেন। 

চায়ের দোকানের লোকজন চলে গেল। দোকানদার মজনু মিয়া বলল- হাসান ভাই, বসেন। দোকান বন্ধ করে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব। 

দোকান বন্ধ করতে করতে মজনু মিয়া বলতে লাগল- ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছও আবার নতুন করে বাঁচার জন্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। নতুন ডাল হয়। নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটায়। ফল ফলায়। এরকম কষ্ট অনেকের জীবনেই আছে। এই যে সারা দিন আমার সামনে চায়ের কেটলিতে পানি ফোটে, একটা কষ্ট আমার ভেতরও ফুটতে থাকে অবিরত। কেউ বোঝে না। বুঝে কী করবে বলেন? এই কষ্টের আগুনে এতটুকু পানি দেওয়ার সাধ্য তো কারও নেই। আমি চা বানায়া মানুষকে খাওয়াই। হেসে হেসে কথা বলি। আনন্দ করি। কিন্তু ভেতরে হৃদয়টা প্রায়ই হাহাকার করে ওঠে। চলেন হাসান ভাই, চলেন যাই।

হাসান উঠে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা ভরাট কণ্ঠে গেয়ে উঠল- 
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে 
আমার পৃথিবী থেকে...

জীবনের স্বাদ

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২০ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২০ পিএম
জীবনের স্বাদ

ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে-
নিদারুণ সময় স্রোতের বেড়াজালে থমকে গেছি।
উপেক্ষিত হয় ভালোবাসার আবেদন,
পরিযায়ী পাখির মতো-
নীল জলে প্রাসাদ গড়ে নীরবতা,
উপেক্ষার সরলসূত্র ধরে জীর্ণ জীবনতরী
গোপন আগুনে জ্বলেছি জমে যাওয়া অভিমানে,
উপসংহারের পথে হাঁটতে থাকি একাকী,
নিঃস্ব জীবনে ভাসতে ভাসতে জেনেছি-
প্রিয়জনের স্পর্শ ছাড়া
পাওয়া যায় না জীবনের স্বাদ।

পুতুলজন্ম

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
পুতুলজন্ম

‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’
হেমন্ত ছুঁয়ে তোমায় ছুঁয়েছি বারবার 

সে কিশোরীবেলা, বালিকা-বালিকা দিন 
হলুদ-ছোপানো রঙে বেণীপুতুল সাধ 

প্রহর শেষের আলো তোমার দু’চোখে 
অঙ্গারে রাঙা নির্মিত চলাচল 

কাদামাটি ছেনে গড়েছ আমায় 
অস্তরাগের সে রোদে 
                                শুধু  
                                       পুড়ে গেলাম...!