![কালিজিরা-কাটারিভোগে গর্ব](uploads/2023/12/29/1703827349.kalijira-Rice.jpg)
বাংলাদেশের কালিজিরা, কাটারিভোগ ও তুলসীমালা এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া জিআই পণ্য, আমাদের গর্বের ধান। এসব চালের স্বাদ-গন্ধে মোহিত হয় সবাই। এ জন্য সুপ্রাচীনকাল থেকে এসব ধানের চালের একটি আলাদা কদর রয়েছে, বিশেষ করে ফিরনি-পায়েস, পিঠা-পুলি ও পোলাও-বিরিয়ানি রাঁধতে। তবে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ শুধু একা না, এর সঙ্গে রযেছে পটুয়াখালী-ঝালকাঠির কালিজিরা চাল।
এ দেশে অতীতে শতাধিক জাতের ধান ফলত, যেগুলোর সুগন্ধ রয়েছে, চাল সরু ও ছোট এবং খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা ও গবেষক ড. অরবিন্দ কুমার রায় এ দেশে গবেষণা করে একসময় ১২৪টি সুগন্ধি জাতের তথ্য তার গবেষণাপত্রে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি শুধু কাটারিভোগেরই ১৩ রকম ও কালিজিরা জাতের ১০ রকমের ধান খুঁজে পেয়েছিলেন। কাটারিভোগের এসব প্রকারের ধান আবার অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামেও পরিচিত, যেমন- জটাকাটারি, জিরাকাটারি, চিনিকাটারি ইত্যাদি।
কাটারিভোগ ও কালিজিরা বাংলাদেশের প্রধান দুটি দেশি সুগন্ধি ধানের জাত। এ ছাড়া স্থানীয় বা দেশি জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চিনিগুঁড়া, খাসকানি, বাদশাহভোগ, দুলাভোগ, উকনি, বেগুনবিচি, কৃষ্ণভোগ, তুলসীমালা ইত্যাদি। এসব দেশি জাতের স্বাদ ও সুগন্ধ অন্য রকম, তুলনামূলকভাবে অন্য চালের চেয়ে দামও বেশি। কিন্তু ফলন তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় কৃষকরা এখন আর এসব জাতের ধান চাষ করতে চাইছেন না। তবু আশ্চর্যের বিষয় যে, বাজারে পোলাও খাওয়ার চালের কোনো অভাব নেই। টাকা থাকলেই যে কেউ এ চাল কিনতে পারেন। এমনকি সীমিত পরিমাণে হলেও এসব সুগন্ধি চাল এখন বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
এই অভাবনীয় সাফল্য এসেছে দেশি জাতগুলোর চেয়ে বেশি ফলন দেওয়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবিত কিছু উচ্চফলনশীল জাতের কারণে ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দ্বারা সেসব জাত কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণের কারণে। সুগন্ধি জাতের ধান চাষের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র এ দেশের উত্তরাঞ্চল- দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় এর চাষ করা হয়।
উন্নত ও উচ্চফলনশীল সুগন্ধি জাতগুলোর মধ্যে ব্রিধান-৩৪, ব্রিধান-৩৭, ব্রিধান-৩৮, ব্রিধান-৭০, ব্রিধান-৮০, ব্রিধান-৯০, বিনাধান-৯ ইত্যাদি। ব্রিধান-৩৪ জাতের ফলন কাটারিভোগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় কৃষকরা এ জাতের সুগন্ধি ধান চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। সর্বশেষ উদ্ভাবিত সুগন্ধি জাত ব্রিধান ৯০-এর জীবনকাল ব্রিধান-৩৪ জাতের চেয়ে ২২ দিন কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর জেলার উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিবছর দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলায় প্রায় ৮৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি জাতের ধান চাষ করা হয়, এর মধ্যে প্রায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতেই চাষ করা হয়েছে ব্রিধান-৩৪, বাকি জমিতে অন্যান্য সুগন্ধি জাত। মূলত এ জাতের ফলন বেশি হওয়ায় জনপ্রিয়তা বাড়ছে। নতুন জাত হিসেবে অল্প হলেও চাষ করা হয়েছে ব্রিধান-৭০ জাতটি। এবারও আমন মৌসুমে প্রায় একই পরিমাণ জমিতে সুগন্ধি ধানের চাষ হবে বলে তিনি আশা করছেন।
তবে আশঙ্কার কথা হলো, ফলন কম হওয়ায় কাটারিভোগের জন্মভূমি দিনাজপুরেই এখন কাটারিভোগ নির্বাসিত হতে চলেছে। তেমনি কালিজিরা জাতের চাষও কমছে। যে কাটারিভোগ ও কালিজিরা আমাদের গর্বের কৌলিসম্পদ, আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি হিসেবে জিআই পণ্যের মর্যাদা অর্জন করেছে, তাকে তো হারাতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ জাত রক্ষায় এখন গবেষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বাসমতীর মতো কাটারিভোগও হয়তো আর আমাদের গর্বের ধান থাকবে না। তখন হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশের এই ডাঙা ছেড়ে হায় কবিতার মতো বলতে হবে: বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে’ উটির পর্বতে/ যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে।