বাংলাদেশে বহু বছর ধরে শিক্ষার অধিকার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন বাংলাদেশে অনেকগুলো গণতান্ত্রিক অধ্যায় তৈরি করেছে। ১৯৬২ সালে শিক্ষার অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন হয়, সে আন্দোলনই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধের সূচনা করেছিল। তার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামরিক শাসন প্রতিরোধের এক একটা দুর্গ তৈরি হয়েছিল। শিক্ষকরাও জড়িত ছিলেন। শিক্ষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়েই তারা বুঝতে পেরেছেন যে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা চলছে, তার পরিবর্তন না করলে শিক্ষার অধিকারও পাওয়া যাবে না। সে জন্য তারা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করেছেন এবং এক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি তুলেছেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান তারই ফসল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফা এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকেই উত্থাপিত হয়েছিল।
এই আন্দোলন দমাতে তখন একটা সংগঠন আইয়ুব খানের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। তাদের নাম হচ্ছে 'এনএসএফ' (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট)। যেখানেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে তারা বাধা দিচ্ছিল, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার জন্য আন্দোলন করেছে, শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেছে সেখানেই তারা অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হলে তারা আতঙ্ক তৈরি করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. আবু মাহমুদের ওপরও তারা আক্রমণ চালিয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে সেই এনএসএফের ধারাবাহিকতার অবসান ঘটবে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই এনএসএফ জীবিত আছে। বিভিন্ন সরকারের সময় এনএসএফ বিভিন্ন নামে আবির্ভূত হয় এবং গত ১৪ বছরে যে সরকার রয়েছে, সে সরকারের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ হিসেবে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। সব ধরনের প্রতিবাদে মানুষের অধিকার, শিক্ষার্থীদের অধিকার, জনগণের অধিকার সেগুলোর ওপর হামলা করা, নিপীড়ন সন্ত্রাসই তাদের প্রধান কাজ। যারা প্রশাসনে থাকে, যারা দখলদার, যারা লুটেরা পুঁজিপতি, যারা নির্যাতক তাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করা যেন তাদের দায়িত্ব। যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল তার উল্টো যাত্রাই দেখেছি আমরা। বিভিন্ন সরকারের সময়ে এবং শিক্ষার ভয়াবহ বাণিজ্যিকীকরণ তার অন্যতম সহযাত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের আগে লড়াই করেছে শিক্ষার্থীরা, মুক্তিযুদ্ধের পরও শিক্ষার জন্য গণতন্ত্রের জন্য সেই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হয়েছে। আমরা আশির দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন দেখেছি। আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ষাট দশকের মতোই ছাত্র আন্দোলন দিয়েই শুরু হয়েছিল। ১৯৮৩, ৮৪ সালে আমরা খুবই শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন বিকশিত হতে দেখি। সেই আন্দোলন গড়ে তোলায় ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পর রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরই অনুসরণ করেছে। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের আগে সব ছাত্র সংগঠন মিলে একটা ঐক্যমতে এসেছিল ১০ দফার ভিত্তিতে।
১৯৬৯ এর ১১ দফা, ৮০ দশকের ৫ দফা, তারপর ৯০ সালের যে ১০ দফা এই সবগুলোর মধ্যেই শিক্ষা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, সব নাগরিক তার আয় যাই থাকুক না কেন শিক্ষায় প্রবেশে তার কোনও বাধা থাকবে না, রাষ্ট্র সেটা নিশ্চিত করবে। কিন্তু গত পাঁচ দশকে আমরা রাষ্ট্রীয় যাত্রা দেখছি উল্টো। মুক্তিযুদ্ধের আগে যারা ছাত্রনেতা ছিলেন, যারা ১১ দফা দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই পরে মন্ত্রী হয়েছেন, বড় বড় কোটিপতি হয়েছেন, এই উল্টো যাত্রায় তারাও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের ভূমিকা পালন করেছেন। এটাকে বলতে হবে বিশ্বাসঘাতকতা। ৯০-এর ১০ দফায় যারা ছিলেন ছাত্রনেতা তারাও পরে অনেকেই বড় বড় কর্তা হয়েছেন, তারাও এই উল্টো যাত্রাকে আরও গতি দিয়েছেন।
আজকে যে মাত্রায় বাংলাদেশে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে তা পৃথিবীর খুব কম দেশেই হয়েছে। আমরা পুঁজিবাদের বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে আছি। কিন্তু পুঁজিবাদের কেন্দ্র যে দেশ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পুঁজিবাদের আরেক অঞ্চল ইউরোপ এসব জায়গাতেও শিক্ষা প্রধানত রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এগুলো নিয়েছে কী কারণে? নিয়েছে এই কারণে যে, সেই সময় সেসব অঞ্চলে জনগণের শক্তিশালী লড়াই ছিল, পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের যে অস্তিত্ব ছিল যেখানে শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুই ছিল জনগণের অধিকার। আশ্রয়, বাসস্থান, কাজ সবকিছুই সেখানে নিশ্চিত। সেই ব্যবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে পুঁজিবাদ আপস করেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র শিক্ষা একটা কেনাবেচার জিনিস। যার কাছে বেশি টাকা থাকবে সে উচ্চ মানের শিক্ষা কিনতে পারবে, যার কাছে টাকা থাকবে না সে পারবে না। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি স্কুল ও কলেজে বেতন কম। কিন্তু তাদের পরীক্ষাতে পাস করতে হলে গাইড বই কিনতে হবে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হবে। গাইড বই, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক লেনদেন এবং শিক্ষকদের নিয়োগ বাণিজ্য সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা খাত মুনাফাখোরদের খাতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নফাঁস হচ্ছে এটারই একটা অনিবার্য পরিণতি। যদি কোচিং সেন্টারকে বাণিজ্য করতে হয়, যদি মুনাফা নিশ্চিত করতে হয় তাহলে তাদেরও চেষ্টা থাকবে এসব। অর্থ উপার্জন, পুঁজি সঞ্চয় একটা উন্মাদনার পর্যায়ে গেছে।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাণিজ্যিকীকরণ, দলীয়করণসহ ভয়াবহ অবনতি তাই বিস্ময়কর কোনও ঘটনা নয়। এমনকি সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা দেখছি এখন বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় যে HEQEP কর্মসূচি চলছে সেটার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, সিলেবাস সবকিছুকে একটা বাণিজ্যিক তৎপরতায় পরিণত করা। যেখানে একজন শিক্ষককে ব্যস্ত থাকতে হয় কেনাকাটা নিয়ে। বাণিজ্যিকীকরণের ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একদিকে যেমন এই HEQEP-এর বিভিন্ন তৎপরতায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকেন্ড ইভনিংসহ নানা প্রাইভেট বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে। অর্থ উপার্জন যেখানে মূল লক্ষ্য সেখানে এই তৎপরতা শিক্ষকদেরও গ্রাস করবে এটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষকদেরও একটা বড় অংশ তাই বাণিজ্যিকীকরণের সুবিধা নিচ্ছেন নিজেদের শিক্ষকতাকে বিসর্জন দিয়ে। শিক্ষকতা, গবেষণা এখন প্রান্তিক বিষয়। এখন মূল বিষয় হচ্ছে যে কোনওভাবে অর্থ উপার্জন করা। এই প্রক্রিয়া পুরো অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ সবকিছুকে গ্রাস করেছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস। যে কোনওভাবে পুঁজি সঞ্চয় যদি মূল লক্ষ্য হয় তাহলে সেই সমাজে সন্ত্রাস, সহিংসতা, আধিপত্য এগুলো বাড়বেই।
আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো একেকটা সন্ত্রাসের আস্তানা, নির্যাতনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে গণরুম এবং সিট বাণিজ্যের মাধ্যমে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে, কোনও রকমে সিট পাওয়ার জন্য কিংবা নিরাপদে থাকার জন্য কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকার জন্য কিংবা মার না খাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সরকারি ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচি, যেভাবে চলতে বলা হয় সেভাবে চলতে হচ্ছে। আজকে যে ছেলেদের দেখছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মিছিল করছে কিংবা হামলা করছে তাদের হাতে রাম দা এবং লাঠি। এই ছেলেরা তো রাম দা, লাঠি ব্যবহার করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। রামদা এবং লাঠি দিয়ে তাদেরই সহপাঠীদের আক্রমণ করার জন্য তো এই ছেলেদের বাবা-মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাননি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি একটা খুবই কঠিন প্রতিযোগিতা। এভাবে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে তাদের মেধা, তাদের অঙ্গীকার, তাদের লেখাপড়া, তাদের অভিভাবকদের ইচ্ছা সবকিছু যে পর্যায়ে থাকে, তার ওপর একের পর এক আঘাত করে এই ছেলেদের বানানো হয় সন্ত্রাসী। এই ছেলেদের ক্ষমতাবানরা সন্ত্রাসী বানায় কেন? কারণ এই বয়সের তরুণদের আরেকটা অংশকে কাবু করার জন্য কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
তরুণরাই তো সৃজনশীলতা দিয়ে, বিজ্ঞানচিন্তা দিয়ে, বিশ্লেষণ দিয়ে, পুরো দেশের ভবিষ্যৎ গতিমুখ পরিবর্তন করবে। তরুণদেরই দায়িত্ব হচ্ছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তরুণদেরই দায়িত্ব হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যকে প্রশ্ন করা। তরুণদেরই দায়িত্ব হচ্ছে যারা প্রবীণ তাদের ভুলভ্রান্তি, বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নমূলক তৎপরতা রাষ্ট্রের অবিচার সেগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো। সেই তরুণদের মধ্যে যদি সর্বক্ষণ আতঙ্ক তৈরি করার জন্য তরুণদেরই আরেকটা অংশকে ব্যবহার করা হয় তাহলে কী হয়? একটা দেশে যে তরুণদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব দেওয়ার কথা সেই তরুণদের ভয়-আতঙ্কে জড়সড় নির্বিকার নির্লিপ্ত জনগোষ্ঠীতে অথবা তৈরি করা হয় যন্ত্র, অস্ত্র এবং অন্যদের হাতিয়ার হিসেবে। এভাবে একটা দেশে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় একটা দেশের ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা যে দেশের আছে, মুক্তিযুদ্ধে তরুণরা তাদের যে ভূমিকা, তারুণ্যের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন সেই দেশে তো এইরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চলতে পারে না। সেই তরুণদের মধ্য থেকেই আসতে হবে সৃজনশীলতা, সেই তরুণদের মধ্য থেকেই আসতে হবে বিশ্লেষণী ক্ষমতা, তরুণদের মধ্য থেকেই আসতে হবে দৃঢ়তা এবং যত ধরনের নিপীড়ন বৈষম্য আছে সেটা যৌন নিপীড়ন হোক, লিঙ্গীয় বৈষম্য হোক, সাম্প্রদায়িকতা জাতি বিদ্বেষ, প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী তৎপরতা যাইহোক এগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব উচ্চারণটা তরুণদের মধ্য থেকেই আসতে হবে। নইলে এই বাংলাদেশ পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ