খাদ্য: আল্লাহতায়ালা জাহান্নামিদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তাদের খাবার হবে জাক্কুম ও কাঁটাদার ফল। পানীয় হবে অত্যুষ্ণ পানি ও দুর্গন্ধ পুঁজ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের খাবার হবে কাঁটাযুক্ত লতাপাতা। এ খাবার তাদের পুষ্ট করবে না; এমনকি ক্ষুধাও নিবারণ করবে না।’ (সুরা গাশিয়া, আয়াত: ৬-৭)
কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘কণ্টক গুল্ম অতি নিকৃষ্ট একটি খাবার।’ (আত-তাখওয়িফ মিনান্নার, ইবনে রজব, পৃষ্ঠা : ১১৫)
এই খাবার জাহান্নামিদের কোনো কাজেই আসবে না, তারা না এর স্বাদ পাবে; আর না এর দ্বারা ক্ষুধা নিবারিত হবে; বরং তাদের এই খাবার দেওয়া হবে শাস্তি হিসেবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় জাক্কুম বৃক্ষ হবে পাপীর খাদ্য। গলিত তামার মতো তা তাদের পেটের ভেতর ফুটতে থাকবে, যেভাবে গরম পানি ফুটতে থাকে।’ (সুরা দুখান, আয়াত: ৪৩-৪৭)
অন্যত্র জাক্কুম বৃক্ষের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপ্যায়নের জন্য উত্তম কি এগুলো না জাক্কুম গাছ? নিশ্চয় আমি তা সৃষ্টি করেছি জালিমদের পরীক্ষাস্বরূপ। এই গাছ উদ্গত হয় জাহান্নামের তলদেশ থেকে। এর মোচা যেন শয়তানের মাথা। তারা এই গাছ থেকে আহার করবে এবং এর দ্বারা তাদের উদর পূর্ণ করবে। এরপর তাদের জন্য থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ। এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুন।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ৬২-৬৮)
উপরোক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, জাক্কুম নিকৃষ্ট প্রজাতির একটি গাছ। এর শিকড় জাহান্নামের গভীরে প্রোথিত। শাখা-প্রশাখা চারপাশে বিস্তৃত। ফল দেখতে খুবই বিশ্রী ও কদর্য। এ কারণেই জাক্কুম ফলকে শয়তানের মাথার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
জাহান্নামিদেরকে এতটাই ক্ষুধার্ত প্রাণীতে পরিণত করা হবে যে, তারা বাধ্য হয়ে এই নিকৃষ্ট গাছ ও তার ফলমূল ভক্ষণ করতে শুরু করবে। বহুদিন ধরে ক্ষুধার্ত থাকা উটের মতো পেটভর্তি করে খাবে। কিন্তু খাওয়া শেষ হতে-না-হতেই এগুলো তাদের পেটে গাদযুক্ত গরম তেলের মতো ফুটতে থাকবে। কঠিন যন্ত্রণায় তারা আর্তনাদ করতে থাকবে। এক মুহূর্তের জন্যও তাদের শাস্তি বন্ধ করা হবে না; বরং ফুটন্ত গরম পানির দিকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে এবং তারা এতটাই তৃষ্ণার্ত থাকবে যে, ওই পানি তারা তৃষ্ণার্ত উটের মতো রুদ্ধশ্বাসে পান করবে। কিন্তু এতে তাদের সমস্যার সমাধান হবে না। উপরন্তু গরম পানি তাদের নাড়িভুঁড়ি সব ঝলসে দেবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পান করানো হবে ফুটন্ত পানি, যা তাদের নাড়িভুড়ি ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) জাক্কুমের কদর্যতা ও নিকৃষ্টতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘জাক্কুম ফলের এক ফোঁটা রস দুনিয়ায় পড়লে, দুনিয়াবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত! তাহলে ওই ব্যক্তির অবস্থা কী হবে, যার খাবার হবে আস্ত জাক্কুম।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৫৮৫)
জাহান্নামবাসীদের আরেকটি খাবার হলো পুঁজ। কোরআনের ভাষায়, ‘আজ তাদের কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই। পুঁজ ছাড়া অন্য কোনো খাবার নেই। এটা শুধু অপরাধীরাই খাবে।’ (সুরা হাক্কাহ, আয়াত: ৩৫-৩৭)
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘এটা সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য। সুতরাং তারা আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানি ও পুঁজ। আরও আছে এমন বিভিন্ন ধরনের শাস্তি।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৫৭-৫৮)
জাহান্নামিদের বিশেষ আরেকটি খাবার হলো আগুন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তারা তো নিজেদের উদর আগুন দ্বারা পূর্ণ করে নেয়। তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০)
পানীয়: পানির অপর নাম ‘জীবন’। কারণ জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য একটি উপাদান। শুধু পানি নয়, পৃথিবীতে আল্লাহ বিভিন্ন প্রকার পানীয় নিয়ামত হিসেবে দান করেছেন। তবে, জাহান্নামের পানীয় হবে একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। সেই পানীয়ের দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ হবে না মোটেও। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের পান করানো হবে ফুটন্ত পানি, যা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৫)
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি আগুন, যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে। তারা পানীয় চাইলে, তাদের দেওয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট পানীয়। আর জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ২৯)
কোরআন-হাদিসে জাহান্নামিদের চার ধরনের পানীয়ের উল্লেখ রয়েছে—
ক. হামিম: হামিম হচ্ছে প্রচণ্ড গরম পানি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা জাহান্নামের আগুন ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছোটাছুটি করবে।’ (সুরা রহমান, আয়াত: ৪৪)
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তাকে পান করানো হবে অতি ফুটন্ত ঝরনা থেকে।’ (সুরা গাশিয়া, আয়াত: ৫)
খ. গাসসাক: গাসসাক বলা হয় দুর্গন্ধ পানি বা পুঁজকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এটা সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য। সুতরাং তারা আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানি ও পুঁজ।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৫৭)
গ. সাদিদ: সাদিদ বলা হয় কাফেরদের গোশত ও চামড়া গলিত চর্বি ও পুঁজকে। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যারা মাদক গ্রহণ করবে, তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর অঙ্গীকার হলো, তিনি তাদের ‘তিনাতুল খাবাল' পান করিয়ে ছাড়বেন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসুল, ‘তিনাতুল খাবাল’ কী? উত্তরে তিনি বললেন, জাহান্নামিদের ঘাম বা গলিত চর্বি।’ (মুসলিম, হাদিস: ২০০২)
ঘ. ‘মুহল’: মুহল হচ্ছে তেলের গাদ, গাদযুক্ত তেল ও ধাতব বস্তু। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নামিদের পানীয় হবে গলিত ধাতব বস্তুর ন্যায়। যখনই এই পানীয় তাদের মুখের কাছে নেওয়া হবে, অমনি তাতে তাদের মুখের চামড়া খসে পড়বে।’ ইবনে আব্বাস (রা.) মুহল শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত মুহল দ্বারা তেলের গাদের মতো ঘন ও আঠালো পানীয় বোঝানো হয়েছে।’ (তাবারি, খণ্ড: ২২, পৃষ্ঠা : ৪)
পোশাক: পোশাক মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লজ্জা নিবারণ ও পরিবেশের ক্ষতিকর উপাদান থেকে বাঁচতে পোশাকের বিকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পোশাকের মাধ্যমে আল্লাহ আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছেন। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিজীবের পোশাকের প্রয়োজন হয় না।
জান্নাতেও আল্লাহ জান্নাতিদের অতুলনীয় পোশাকের মাধ্যমে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সম্মানিত করবেন। আল্লাহ জাহান্নামিদেরও পোশাক থেকে বঞ্চিত করবেন না। তবে, জাহান্নামিদের পোশাকও হবে শাস্তিস্বরূপ। তাদের পোশাক তাদের যন্ত্রণা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। জাহান্নামিদের পোশাক হবে আগুনের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফরি করে, তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে আগুনের পোশাক। তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি।’ (সুরা হজ, আয়াত: ১৯)
অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন আপনি অপরাধীদের দেখবেন, শৃঙ্খলিত অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার এবং আগুন আচ্ছন্ন করে ফেলবে তাদের মুখমণ্ডল।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪৯-৫০)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে, তবে তাকে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপস্থিত করা হবে যে, তার গায়ে থাকবে আলকাতরার জামা ও খোস-পাঁচড়াযুক্ত বর্ম।’ (মুসলিম, হাদিস: ৯৩৪)
লেখক: আলেম, সাংবাদিক ও গবেষক