![সাদা পোশাক জড়ানো পবিত্র আমল হজ](uploads/2024/06/06/sada-ok-1717655089.jpg)
হজ মুসলমানদের বিশ্ব সম্মেলন। সাদা পোশাক জড়ানো পবিত্র আমল হজ। হজকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সামর্থ্যবান মুসলমানরা মক্কায় জড়ো হন। নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত নিয়মে সবাই একসঙ্গে হজের আমল করেন। এসব আমল পালন ও আমলের জায়গাগুলোতে অবস্থানের ব্যাপারে সবাই সমান। আরব-অনারবের কোনো পার্থক্য নেই। ধনী-গরিব কিংবা শ্রেণিবৈষম্যের তফাত নেই। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দিন। তারা আপনার কাছে আসবে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটসমূহের পিঠে (আরোহণ করে), তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ (সুরা হজ, ২৭)
হজ হলো নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/৪৫৪) হজের নির্দিষ্ট সময় হলো জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। দূরের হাজিদের জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করা ওয়াজিব। হজের কাজ হলো ইহরাম, তালবিয়া, তওয়াফ, সাঈ, উকুফে আরাফা, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে মিনা, পাথর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, হলক ও কসর এবং মদিনা ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত ইত্যাদি।
হজের বিধান: হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও ফরজ বিধান। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান, ৯৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লোকসকল, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। এ জন্য হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বুখারি, ৭২৮৮)
হজের প্রকার: হজ তিন প্রকার—হজ্জে ইফরাদ, হজ্জে তামাত্তু, হজ্জে কিরান। ১. হজ্জে ইফরাদ: শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজের সব আমল সম্পন্ন করা। ২. হজ্জে তামাত্তু: শুধু ওমরার নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওমরার কাজ সমাপ্ত করা, এরপর মাথা মুণ্ডিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের সব আমল শেষ করা। ৩. হজ্জে কিরান: একসঙ্গে ওমরা ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই (একই) ইহরামেই ওমরা ও হজ পালন করা।
এ তিন প্রকার হজের মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে সর্বাধিক উত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে সহজতার বিবেচনায় প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান হজ উত্তম। যেহেতু হজ্জে তামাত্তু পালন করা সবচেয়ে সহজ, তাই অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। আর যারা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে, তারা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, তবে এদের সংখ্যা খুব কম। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/৫২৯)
ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল: যে কাজে কষ্ট বেশি, এর সওয়াব ও ফজিলত বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা। প্রশ্ন করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আবার প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, হজ্জে মাবরুর (গ্রহণযোগ্য) হজ।’ (বুখারি, ১৫১৯)
হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীলতা ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে যেন নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরল।’ (বুখারি, ১৫২১)
কবুল হজের বিনিময় জান্নাত: আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক ওমরা আরেক ওমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বুখারি, ১৭৭৩)
হজ না করার পরিণাম ভয়াবহ: সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবু হজ করে না, সে ইহুদি না খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করল, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, ১/৫৭৮)
হজ অস্বীকার বা হজ নিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা করলে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশে সেই ঘরের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তা হলে জেনে রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭) হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান, ৩৭০৩)
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক