![এমপি আজীম হত্যারহস্যের জট খুলছে](uploads/2024/05/29/ajIm-1716956955.jpg)
বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় এখনো কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। ১৫ দিনের মাথায় কিছু মাংসের অস্তিত্ব মিললেও পুরোটা শনাক্ত করতে আরও সময় লাগবে। তবে মরদেহ পাওয়া যাক বা না যাক যেসব আলামত রয়েছে তাতেই প্রযুক্তির সহায়তায় এই হত্যাকাণ্ডের জট খুলবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মরদেহের খোঁজ পেতে কিছুটা দেরি হওয়ায় অনেকেই নানা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি, আইনজীবী, অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ও সিআইডি বলছে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা তেমন কঠিন কিছু না। ঘটনাটি দুই দেশের মধ্যে হওয়ায় একটু সময় লাগবে হয়তো।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অবশ্যই উন্মোচন করা যাবে। যেসব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে এগুলো দিয়েই এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ পেতেই হবে বিষয়টি এমন নয়। ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আনারের রক্ত ও গায়ের শার্ট, গাড়িতে উঠাসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়েছে। এগুলো ফরেনসিক ল্যাবে টেস্ট করা হচ্ছে। রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে এমপি আনার খুন হয়েছেন কি না। আরেও কয়েকটি উপায় হচ্ছে তার পরিবারের ডিএনএ টেস্ট করা, আনারের ঘটনাস্থলের আলামতগুলো সংগ্রহ রাখা ও পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করা।
সিআইডি বলছে, পুলিশ বছরের পর বছর বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য বের করে, লাশ গুম করে দেওয়ার ঘটনায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছে। আনারের ক্ষেত্রেও অনেক কিছু সম্ভব। তবে তার ক্ষেত্রে লাশের পরিচয় বের করা আগে জরুরি। সেই বিষয়টি দুই দেশের পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। সূত্র জানায়, বহুল আলোচিত বিভিন্ন হত্যা মামলার উঘাটন করা হয় নানা পদ্ধতিতে।
পুলিশ, হাসপাতাল ও ডিএমপির সূত্রে জানা গেছে, পরিবারের একাধিক ব্যক্তির ডিএনএ টেস্ট ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির মরদেহ শনাক্ত করা যায়। তা ছাড়া যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেলে বিষয়টি আরও সহজ হবে। এই যুগে এসে ‘ক্লু-লেস’ হত্যাকাণ্ড বলতে কিছু নেই। প্রযুক্তির ব্যবহার করে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ অজ্ঞাত লাশের পরিচয় বের করা সম্ভব।
‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহের ব্যবস্থা নেওয়া হলে অধিকাংশ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব বলে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদ পুলিশ কর্মকর্তারা।’
সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির এবং আসামিদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলালেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
ডিআইজি (ফরেনসিক) এ কে এম নাহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করা যাবে। তবে সময়ের ব্যাপার। দু-দেশের সমন্বয়ে বিভিন্ন কাজ চলছে। ফরেনিক রিপোর্ট এলে এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিচয় ও গুরুত্বপর্ণ বেশ কিছু তথ্য বের হয়ে আসবে।’
সিআইডির সূত্র জানায় ‘একটি হত্যার ঘটনার পর লাশ শনাক্ত করার জন্য সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ টেস্টসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে। লাশের হাতের ছাপ অথবা যদি ঘটনাস্থলে তার রক্ত পড়ে থাকে, সেগুলো সংগ্রহ করা সেই জায়গার ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করলেই অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তবে এমপি আজীমের মরদেহ শনাক্তের জন্য ভারতীয় পুলিশ এবং আমাদের দেশের পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এ হত্যার রহস্য উন্মোচনে কাজ করছে। যেহেতু মরদেহ পাওয়া যায়নি, অপরাধীরা বিভিন্ন জায়গায় গুম করেছে সেই ক্ষেত্রে এ হত্যার আলামত সংগ্রহ করতে একটু সময় লাগবে।’
এই বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে ‘ক্লু-লেস’ হত্যাকাণ্ড বলতে কিছু নেই। হয়তো আনার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে সময় লাগবে। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবে, সেটা আজ হোক অথবা পরে হোক। তবে এই ঘটনার পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে হবে।’
‘ঘটনাস্থল থেকে আনারের যেসব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো ফরেনসিক ল্যাবে পাঠালে অনেক তথ্যপ্রমাণ মিলবে। এবং তার পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ টেস্ট করলে বোঝা যাবে ওই রক্ত আনারের বা ঘটনাস্থলে আনার ছিলেন কি না। তা ছাড়া তদন্তকারী কর্মকর্তারা আসামি পক্ষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট যদি সংগ্রহ করতে পারে, সেটিও সংগ্রহ করলে ভালো তথ্য আসবে। অনেক সময় এই ধরনের খুনের ঘটনায় আসামিরা আলামত নষ্ট করে দেন, কিন্তু সেগুলো ব্যবস্থা করা তেমন কঠিন কিছু না।’
পুলিশের আরেক সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশ ইচ্ছা করলে অনেক কিছু পারে। এক্ষেত্রে আনার হত্যাকাণ্ড রহস্য উন্মোচন করা তেমন কঠিন কিছু না। আমি মনে করি এটা খুব সহজ। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোনোভাবেই হত্যার সব আলামত ধ্বংস করা সম্ভব না। যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলোর সূত্র ধরে দরকার হলে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে হবে। অথবা যেসব দেশে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি আছে, সেই দেশের সহযোগিতা নেওয়া। ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা, ডিএনএ টেস্ট থেকে শুরু করে সব আলামত বিশ্লেষণ করলে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন অনেকটা সম্ভব।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সাধারণত সেইভাবে হয় যাতে লাশ পাওয়া না যায়। এমপি আনারের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। অনেক সময় লাশ পাওয়া যায় না। যদিও লাশ পাওয়া যায় হয়তো সেগুলো টুকরো টুকরো করা। আনার হত্যার ঘটনায় অনেক আলামত পুলিশ সংগ্রহ করলেও জঙ্গলে ফেলে দেওয়া কোনো অংশ উদ্ধার করতে পারেনি। হত্যাকারীরা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে হত্যা করেছে।
সাধারণত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো পূর্বে আমরা দেখেছি এমনটা হয়। যেটাকে ‘ক্লু-লেস’ হত্যাকাণ্ড বলে। তবে আমাদের দেশে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটালে এতদিন রহস্য উন্মোচন হয়ে যেত। যেহেতু পাশের রাষ্ট্রে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তির যুগে এসে অনেক কিছু সম্ভব আশা করি একটু সময় লাগলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এই হত্যার আসল রহস্য উন্মোচন করা এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা। কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যাতে ফেঁসে না যান সেদিকে খেয়াল রেখে তাদের কাজ করতে হবে।
আইনজীবী ফেরদৌস সুলতানা বলেন, আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ‘ক্লু-লেস’ না। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা তার রক্তমাখা শার্ট এবং গাড়িতে উঠানোর ফিঙ্গার এগুলোর সব আলামত সিআইডি ফরেনসিক রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে। ঘটনাস্থলে পাওয়া রক্তের নমুনা নিয়ে, তার পরিবারের ডিএনএ টেস্ট করলে বোঝা যাবে সেটা আনারের কি না। সর্বপ্রথম তিনি মারা গেছেন কি না সেটা নিশ্চিত করা। তারপর সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে আসামিদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের আলামত সংগ্রহ করে আদালতকে জানানো।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক আব্দুল নুর দুলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমপি আনারের লাশ পাওয়া না গেলেও ডিএনএ টেষ্ট করা যেতে পারে। তা ছাড়া অন্যান্য আলামত, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও পারিবারিক তথ্যের ভিত্তিতেও হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যুর বিষয়টি প্রমাণ হতে পারে।’