চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, এটা নতুন কিছু নয়। তবে যদি তিন-চার গুণ বেড়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সবার নজরে পড়ে। কিন্তু নজরে এলেও বিমানের টিকিটের বেলায় যেন অসহায় হয়ে পড়েন যাত্রীরা। এর বড় উদাহরণ গত মে মাসের মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা। ৩০ হাজার টাকার টিকিট লাখ টাকার বিনিময়ে কেটেও ফ্লাইট পাননি অনেকে। কেবল যে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোই বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটের টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে এমন নয়, ঈদ সামনে রেখে বেড়ে যায় অভ্যন্তরীণ রুটের টিকিটের দামও। অভ্যন্তরীণ রুটের যে টিকিটের দাম পড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা, ঈদের সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ থেকে ১১ হাজার টাকা।
এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্ট মহল বলছে, বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর বিপুল ডলার আটকে থাকা এবং সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদা বাড়লেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে বিমানের টিকিটের দাম।
দেশের ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ খবরের কাগজকে বলেন, চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। কারণ যখন মন্দা যায়, তখন তো সেই ভার অন্য কেউ নেয় না। ফলে যখন চাহিদা বাড়ে, তখন বিমানের টিকিটের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। তবে এটি এয়ারলাইনসগুলোর সিন্ডিকেশনের কারণেই হয়। তারা টিকিগুলো ৫-৬টি ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়ে দেয়। ফলে ওই এজেন্সিগুলো দাম বাড়িয়ে দেয়। আর এ কারণেই গ্রাহকরা প্রয়োজনের সময় বেশি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হন।
বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিমানের টিকিটের চাহিদার বিপরীতে আসনসংখ্যা বেশির ভাগ রুটেই কম রয়েছে। ফলে যখন চাহিদা একটু বেড়ে যায়, অর্থাৎ আসন আছে ১০০টি আর চাহিদা ১২০টি, তখন এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়। কেবল এয়ারলাইনসগুলো দাম বাড়ালেও হয়তো গ্রাহকের ওপর অতটা চাপ পড়ত না, কিন্তু এয়ারলাইনসগুলো যখন একটু দাম বাড়ায়, তখন আবার কয়েকটি বড় ট্রাভেল এজেন্সি এই টিকিটগুলো কিনে স্টক করে। পরে সেগুলো তারা অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে টিকিট কিনতে তখন গ্রাহককে তিন-চার গুণ বেশি টাকা গুনতে হয়। এর পাশাপাশি দেশে যেভাবে ডলারের দাম বাড়ছে, তাতে সামনের দিনে টিকিটের দাম আরও বাড়তে পারে।’
গত এপ্রিলে এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈশ্বিক এয়ারলাইনসগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) জানায়, বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর পাওনা প্রায় ৩২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আটকে আছে। অবিলম্বে এ অর্থ পরিশোধের তাগাদাও দিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সহসভাপতি ফিলিপ গোহকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি মুদ্রা ব্যবহারে কৌশলী হওয়া দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি সরকারের জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জও বটে। তবে সময়মতো এবং কার্যকর পদ্ধতিতে দেনা পরিশোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিমান সংযোগ হ্রাস ঠেকানো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, বিদেশি বিনিয়োগ এবং রপ্তানির সম্ভাবনাকে ঠিক রাখার জন্যই এটি জরুরি।’
অবশ্য বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইনসের টাকা আটকে থাকার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। গত বছরের জুনেও একবার পাওনা আদায়ের তাগিদ দিয়েছিল আইএটিএ। সে সময় সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর প্রায় ২১৪ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার আটকা পড়েছে।
বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর বিপুল পরিমাণ ডলার আটকে থাকায় সামনের দিনগুলোতে এই ডলারের ভবিষ্যৎ মুনাফা ধরে দাম নির্ধারণ করায় বাংলাদেশ থেকে টিকিটের দাম আরও বাড়তে পারে। এমন শঙ্কা এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় পড়তে পারেন বাংলাদেশি যাত্রীরা।
এ বিষয়ে আটাবের সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারসংকটের কারণে এয়ারলাইনসগুলো ডলার নিতে পারছে না নিজ দেশে। তবে কিছু প্রভাবশালী এয়ারলাইনস অল্প করে ধাপে ধাপে তাদের আটকা পড়া ডলার দেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু বাকি অনেকেই ভুগছেন তাদের আটকা পড়া এই মূলধন নিয়ে। এর ফলে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো এ দেশে তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এয়ারলাইনসগুলো ব্যবসা করতে এসেছে এই দেশে। তারা টিকিট বিক্রি করল, টাকা সংগ্রহ করল, কিন্তু দেশে নিতে পারছে না। এভাবে কেউ ব্যবসা করবে? এটার অ্যাফেক্ট হচ্ছে বিভিন্ন এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট কমিয়ে দিচ্ছে। এতে টিকিটের দাম আরও বেড়ে যাবে।’
আবার বাংলাদেশ থেকে টিকিটের দাম বেশি- এ কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিদেশ বা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে সেই একই টিকিট কমে কেনা যায় এমন অভিযোগ আছে অনেক গ্রাহকের। এ বিষয়ে আবদুস সালাম আরেফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এর বড় কারণ হলো এই যে এখানে টাকা আটকে থাকে। কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের দাম বাড়িয়ে তাদের কস্ট অব ফান্ড অ্যাডজাস্ট করছে। এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে কম দামের যে টিকিটগুলো আছে, সেগুলো তারা বাংলাদেশে বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু বিদেশি বিভিন্ন এজেন্সি বিশেষ করে ভারতের এজেন্সিগুলোকে দিয়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশ থেকেই টাকা বিদেশে যাচ্ছে, কিন্তু অবৈধভাবে, হুন্ডির মাধ্যমে।’
কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘বিদেশি এয়ারলাইনস যারা এখানে অপারেট করছে, কিন্তু টাকা ফেরত নিতে পারছে না মাসের পর মাস। স্বাভাবিকভাবেই তারা ব্যবসায়িক ক্ষতি পোষাতে নানা চেষ্টা করবে। এর প্রভাবে এখন পাশের দেশের তুলনায় এ দেশে টিকিটের দাম বেশি। কম দামের টিকিটগুলো এখান থেকে পাওয়া যায় না। এগুলো বিদেশে বিক্রি হয়। এতে এয়ারলাইনসগুলো দ্রুত ডলার নিজের দেশে নিতে পারছে।’
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশ থেকে নতুন ফ্লাইট শুরু করার বিষয়ে আগ্রহ হারাবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম আরও বলেন, ‘ডলার লেনদেনের এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। ইমেজ সংকট তৈরি হবে। বিদেশি এয়ারলাইনস, যারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অপারেট করতে চায়, ডলারের এই লেনদেন দেখে তারা নিরুৎসাহিত হবে।’
বর্তমানে দেশের এভিয়েশন বাজারের ৮০ ভাগের নিয়ন্ত্রণই বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর হাতে। ফলে বিদেশি এয়ারলাইনসের টিকিটের দাম বেড়ে গেলে তা সামগ্রিকভাবে পুরো বাজারেই প্রভাব ফেলে। এতে সামনের দিনগুলোতে বেড়ে যেতে পারে আকাশপথে ভ্রমণের খরচ।