![বাংলাদেশ-ভারত বহুমুখী যোগাযোগ: কোন দেশের কী লাভ](uploads/2024/06/29/bd-india-1719637933.jpg)
ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও করিডর দিয়েছে বাংলাদেশ। বিনিময়ে বাংলাদেশও নেপাল এবং ভুটানে পণ্য পরিবহনে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারবে। বর্তমানে দুই দেশের গণমাধ্যমেই হিসাব-নিকাশ চলছে যে দুই দেশের মধ্যে এত কানেকটিভিটি বা সংযোগে আসলে কার কী লাভ।
চলতি বছরের ২২ জুন রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও দিল্লি। এর ফলে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিবমাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব অনেক কমে যাবে। ফলে বিপুল সময় ও অর্থ বাঁচবে ভারতের। আর বাংলাদেশ পাবে নির্ধারিত হারে মাশুল ও ফি। এ ছাড়া পরিবহন ব্যবসা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ দুই পক্ষেরই ইতিবাচক ফলাফলের সম্ভাবনা আছে। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের দূরত্ব ও ব্যয় কমবে। বাংলাদেশও লোডিং-আনলোডিংয়ের ব্যবসা করতে পারবে। বাংলাদেশের জাহাজ যেন এই ব্যবসা ধরতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতকে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিতে শুরু করেছে ২০১০ সালে। দুই দেশের মধ্যকার নৌ-প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে এটি শুরু হয়। প্রথমে কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, তারপর আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া-আগরতলা পর্যন্ত সড়কপথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারের জন্য ২০১৬ সালে টনপ্রতি ১৯২ টাকা ধার্য করা হয়।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারছে ভারত। বন্দর থেকে ভারতীয় পণ্য খালাস করে সেই পণ্য বাংলাদেশের পরিবহন দিয়ে আবার আগরতলা সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভারতের লাভ
ভারতের পশ্চিমের রাজ্যগুলো থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কিলোমিটার। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ১৫০ কিলোমিটার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ দূরত্ব ৫৭০ কিলোমিটার।
মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কিলোমিটার আর কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার।
কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রামের তুলনায় গড়ে তিন গুণের বেশি। ফলে এখন পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে পণ্য পরিবহনে ভারতের সময় ও অর্থ অনেক ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত কানেকটিভিটির কারণে দিল্লির বিপুল সময় ও অর্থ বাঁচবে।
ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত-মায়ানমারসহ আসিয়ানভুক্ত দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। ভারতের ‘লুক ইস্ট নীতির’ বাস্তবায়নও সহজ হবে এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশের লাভ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারবে। বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় খুবই কম। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ২২ শতাংশ করতে চায়। সে ক্ষেত্রে এই টোল এবং ফির মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে পারবে বাংলাদেশ।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা করার পরও যাতে ভারতে বাংলাদেশের অধিকাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকে সে জন্য এই কানেকটিভিটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া বাংলাদেশের সেবা খাতের প্রসার ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এই ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন তথা লজিস্টিক সাপোর্ট সম্প্রসারণের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট কার্যকর করতে অবকাঠামো খাতে রাস্তা-ঘাট-সেতু ইত্যাদিতে উন্নয়ন ঘটবে। স্থল ও সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। বাড়বে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ।
ভারতও বাংলাদেশকে ট্রানজিট দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, ইরান ইত্যাদি দেশে পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য বাড়াতে এই কানেকটিভিটি ভূমিকা রাখবে। নেপাল-ভুটানের মতো ল্যান্ডলকড দেশ এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মহেশখালীতে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের চতুর্থ সমুদ্রবন্দর, যা হবে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ায় এ সমুদ্রবন্দরটি ভারত ব্যবহার করবে এবং বাংলাদেশের আয় অনেক বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।