পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ বাড়াতে বাকিতে পণ্য আনার সুযোগ, শূন্য মার্জিন ও কম সুদে আট ধরনের পণ্য আনার সুযোগ দেওয়া হলেও এর সুফল তেমন কোনো কাজে আসেনি এখন পর্যন্ত। বরং নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বাড়ছে। রমজান শুরুর দুই মাস আগে এ সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র জানায়, পণ্য সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা কাজে না আসার অন্যতম কারণ ডলার সংকট।
সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বাজার পরিদর্শনে জানা গেছে, রমজানে বহুল ব্যবহৃত দুই খাদ্যপণ্য খেজুর ও ছোলার দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। গত শুক্রবার বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয় ১১০-১১৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও এর দাম ছিল ১০০-১০৫ টাকা। আর ২৫০ টাকায় যে খেজুর এক কেজি পাওয়া যেত তার দাম এখন ৫০০ টাকা। বাজারে কমপক্ষে ১০ ধরনের খেজুর পাওয়া যায়। বেশি দামের খেজুরের দামও বেড়েছে আনুপাতিক হারে। ভালো মানের খেুজর কেজিপ্রতি ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ওই আট পণ্যের মধ্যে খেজুর এবং ছোলা ছিল। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি, মসলা ও পেঁয়াজ। চলতি বছরের জানুয়ারির ১১ তারিখে এ সুযোগ উন্মোচিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা যায়, উল্লেখিত সুযোগ দেওয়া পর জানুয়ারির ১৭ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি নির্দেশে ব্যাংকগুলোকে নিত্যপণ্য আমদানিতে ডলারে রেট কমা রাখা এবং সুদহার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বলা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের দেওয়া ওইসব সুযোগের আওতায় আট পণ্যের আমদানি সুযোগ নেয়নি কোনো ব্যবসায়ী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে চিনি আমদানিতে রেকর্ড মূল্য পরিমাণ ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত মসলা, গম, খেজুর, ডাল ও তেল। কিন্তু পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে খুবই কম পরিমাণ।
ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছেন, ডলার সংকট ও বিনিময় হার বেশি হওয়ার কারণে ছোট ও ব্যক্তি পর্যায়ের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুযোগ নিতে পারেনি। ব্যাংকের অসহযোগিতাকেও দায়ী করেছেন তারা।
বলেছেন, বড় প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে নিত্যপণ্যের আমদানি, সরবরাহ ও দর নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো। এ কারণে মূল্য নিয়ন্ত্রণে ছোট ব্যবসায়ী ও পাইকারি পর্যায়ে নিজেদের মতো করে কিছু করার সুযোগ নেই। কারওয়ানবাজারে চাঁদপুর ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম খবরের কাগজকে বলেন, আমরা এখন শুধু ব্যবসাটা করে টিকে আছি। মালের দাম (পণ্য মূল্য) ফিক্সড করে দেওয়া আছে। আমি ও অন্য সব আড়তদার ওই দামই অনুসরণ করি।
আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকের অসহযোগিতার বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সব নীতি সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এ সুযোগ যদি কেউ না পায় তাহলে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমরা তেমন অভিযোগ পাইনি। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তার প্রতিফলন নেই বাজারে। সরকার দাবি করছে, বাজারে নিত্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে কেউ ‘সরবরাহ নেই’ দাবি করে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে না পারে। কিন্তু বাজারে সরবরাহের ঘাটতি চোখে না পড়লেও দাম নিয়ে অসন্তোষ আছে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত জানুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
কী ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায়: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, ৮ ধরনের পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এতে বলা হয়, এ সুবিধা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে। রোজায় ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ: রমজান মাসে বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ রাখতে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো শূন্য মার্জিনে এলসি খোলারও পরামর্শ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে, কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনাও করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এক বছর ধরেই বাজারের অস্থিতিশীল। মূল্য পরিস্থিতির কারণে রোজার মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে খোদ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তার উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও তত্ত্বাবধান করে আসছেন। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই দীর্ঘদিন ধরেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও অর্থনীতির বাইরের কারণগুলো আমলে নিতে হবে। তা না হলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশ তার সুফল পাবে না।