![ঋণের চাপে কম দামে ধান বিক্রি, মিলার-আড়তদার সিন্ডিকেট](uploads/2024/06/03/paddy-picture-(1)-1717401260.jpg)
কাটা-মাড়াই শেষ। তাই উৎপাদন খরচ ও ঋণ পরিশোধ করতে ফলন বেচে দিতে হচ্ছে। আর এই সুযোগে মিলার ও আড়তদাররা যোগসাজশ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে কম দরে ধান কিনছেন। পরবর্তী সময়ে বেশি দামের আশায় মজুত করছেন অনেক মিলার ও ব্যবসায়ী। এতে ঠকছেন চাষি। এমন অভিযোগ করেছেন নওগাঁর কৃষকরা।
জানা গেছে, উৎপাদন ভালো হওয়ায় হাসিমুখে নওগাঁর কৃষকরা ধানবোঝাই গাড়ি নিয়ে হাটে এসেছেন। কিন্তু মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে সেই হাসি মলিন হয়ে গেছে। হাটগুলোতে মণপ্রতি ধানের দাম কমেছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে ঋণ ও উৎপাদন খরচ পরিশোধের চাপে লোকসানেই ফলন বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকেই।
চাষিরা জানান, মৌসুমের শুরু থেকেই চাষাবাদের বেশির ভাগ ব্যয় ঋণ করে মেটাতে হয়। এ ছাড়া হাল, সেচ, সার, কীটনাশক ও অন্য কৃষি উপকরণ মহাজন বা দোকান থেকে বাকিতে নেন চাষিরা। ফলন উঠলেই সেগুলো মহাজনি হালখাতার মাধ্যমে পরিশোধের চাপ তৈরি হয়। তাই বাধ্য হয়েই ভরা মৌসুমে কম দামে ধান বিক্রি করতে হয় তাদের।
নওগাঁ জেলায় ধামইরহাট, সাপাহার, মধইল, শিশা, ছাতড়া, চৌবাড়িয়া, চকগৌড়ি, স্বরস্বতীপুর, মহাদেবপুর, মাতাজি ও আবাদপুকুর ধানের বড় হাট হিসেবে পরিচিত। চাষিদের অভিযোগ, হাটগুলোতে এবারও ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মিলার ও আড়তদার সিন্ডিকেট। সুযোগ বুঝে কম দামে ধান কিনছেন তারা। এদিকে ঋণ-দেনা পরিশোধে বাধ্য হয়েই লোকসানে ধান বিক্রি করছেন কৃষক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উৎপাদন ভালো হওয়ায় হাটগুলোতে ধানের ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। গোলা থেকে ধান এনে আড়তে বিক্রি করছেন চাষিরা। কিন্তু মিলছে না ন্যায্য দর। মৌসুমের শুরুতে কাঁচা ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকা মণ। অথচ এখন ভরা মৌসুমে শুকানো ধানের দর এক হাজার ৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ১০০ টাকা। গত শনিবার মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌড়ি হাট ও মাতাজি আড়তে কাটারি ও সুবর্ণলতা ধানের সর্বোচ্চ দর ছিল এক হাজার ৪০ টাকা। জিরাশাইল বিক্রি হয়েছে এক হাজার ১০০ টাকায়।
ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিমণ ধানের দর বেঁধে দিয়েছে ১ হাজার ২৮০ টাকা। অথচ সেই দরে ধান বিক্রি করতে পারছে না কৃষক। হাটগুলোতে নৈরাজ্য তৈরি হলেও দেখার কেউ নেই। তদারকির অভাবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। মৌসুমের শুরু থেকেই বাজারে তদারকি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই বলে অভিযোগ করেন চাষিরা।
মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজি গ্রামের কৃষক আজিজুল হক বলেন, ‘ধান রোপণের সময় সার, হাল ও সেচের খরচ পরিশোধ করতে পারিনি। ধান বিক্রি করে পরিশোধ করার জন্য এখন পাওনাদাররা চাপ দিচ্ছেন।’
বড় সাঁওতা গ্রামের বর্গাজমি চাষ করা মজির সোলেমান বলেন, ‘ধান চাষ করা কঠিন হচ্ছে। জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করে কোনো লাভ নেই। এক ফসলের জন্য প্রতি বিঘায় পাঁচ হাজার টাকা বর্গামূল্য দিতে হয়। এমনিতেই লোকসান; অন্যদিকে মাথায় বড় বোঝা জমির বর্গামূল্য পরিশোধ করা। ধান কাটার পর জমির মালিক টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাই নতুন ধান উঠান থেকেই বিক্রি করছি।’
হাটে ধান বিক্রির পর উপজেলার উত্তরগ্রাম এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম জুয়েল জানান, চলতি মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। গড়ে প্রতি বিঘায় তিনি ২৪ মণ ধান পেয়েছেন। তাতেও লাভ হচ্ছে না। কারণ সার, কীটনাশক, হাল, সেচ ও কৃষিশ্রমিকের মজুরিতে খরচ বেড়েছে। সে তুলনায় ধানের দর পাচ্ছেন না।
মজনুল সরদার নামে আরেক প্রান্তিক চাষি চলতি মৌসুমে ধানের উৎপাদন খরচের ফিরিস্তি তুলে ধরে জানান, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রতি বিঘায় হালখরচ ৩০০ টাকা বাড়তি। আগে ছিল ৯০০, এখন এক হাজার ২০০ টাকা (চার চাষ)। সেচচার্জ প্রতি বিঘায় ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোয় চলতি মৌসুমে পানির দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
তিনি আরও জানান, কৃষককে সবচেয়ে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে ফসলে কীটনাশক কিনতে গিয়ে। কারণ লাগামহীন বাজারে বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়েছে বালাইনাশকের দাম। খেত বাঁচাতে উচ্চমূল্যে কীটনাশক কিনতে হয়েছে। বিঘায় খরচ হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা। রাসায়নিক সারে খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। বীজ কেনা, বীজতলা ও চারা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া চারা রোপণ, নিড়ানি ও কাটা-মাড়াইয়ে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি খরচ প্রায় ২৫ হাজার টাকা। বিপরীতে উৎপাদিত ফলন বিক্রি করে সেই খরচ উঠছে না।
আড়তদাররা বলছেন, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বেড়েছে। তাই ধানের দামও কমেছে। সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করছেন তারা।
স্বরস্বতীপুর হাটের আড়তদার মকবুল হোসেন বলেন, ‘কমিশনের ভিত্তিতে আড়তে ধান কেনা হয়। দর নির্ভর করে বড় মিলার ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের মর্জিমতো। তাদের নির্ধারিত ধরেই ধান বেচাকেনা করতে হয়। চালের বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধানের দাম নির্ধারণ করা উচিত।’
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান বলেন, ‘চাষিদের লাভবান করতে সরকারি গুদামে ন্যায্যদরে ধান কেনা হচ্ছে। কিন্তু কাঁচা ধানের দর বেশি পেয়ে কৃষক খোলা বাজারে বিক্রিতে বেশি আগ্রহী। ভরা মৌসুমে হাটে সরবরাহ বাড়ায় দরে কিছুটা প্রভাব পড়লেও ধান বিক্রি করে চাষিরা লাভবান হবেন।’
নওগাঁর জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা বলেন, ‘ধান কেনার সময় ব্যবসায়ীরা সব সময় কৃষককে ঠকানোর চেষ্টায় থাকে। কিন্তু কোনোভাবেই তাদেরকে সিন্ডিকেট করে দর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হবে না। বাজারে নজরদারি ও তদারকি বাড়ানো হবে।’