আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনেই ব্যবহার করা হচ্ছে না ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংগ্রহে থাকা প্রায় ৪৬ হাজার ইভিএমে যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। সেগুলো মেরামত ও নতুন করে ইভিএম কিনতে বরাদ্দ না পাওয়াসহ নানা কারণে ইসি এবার সব আসনেই ব্যালট পেপারে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ সব ভোটেই ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা ইসির রয়েছে।
ইসির নির্বাচনী রোডম্যাপে এবার সংসদ ভোটে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা ছিল প্রথমে দেড় শ আসনে। পরে সরকারের বাজেট সংকোচন নীতির কারণে তা ৭০ থেকে ৮০টি আসনে কমিয়ে আনা হয়। পরে বিদ্যমান ইভিএম সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে চাওয়া বরাদ্দ না পাওয়ায় ইভিএম পদ্ধতি থেকে সরে আসে সংস্থাটি। এ ছাড়া ইভিএম নিয়ে ইসি আয়োজিত সংলাপে রাজনৈতিক ঐকমত্যেরও অভাব ছিল।
সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার না হওয়া ইভিএম মেশিনগুলোর কী অবস্থা? আর নির্বাচনের এই সময়ে ইসির সংগ্রহে থাকা দেড় লাখ ইভিএম সংরক্ষণ ও সচল রাখতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্থাটি- এমন প্রশ্নের উত্তরে ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা না হলেও সেগুলো যাতে অকার্যকর ও নষ্ট হয়ে না যায় তার জন্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ৪৬ হাজার ইভিএমে টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছিল। তার মধ্যে অল্পসংখ্যক পুরোপুরি নষ্ট হলেও বাকিগুলো মেরামতের পর ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হয়।’
ইভিএমগুলো কোথায় রাখা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ঢাকারগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ); যার সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৪২। এ ছাড়া কাস্টমাইজেশন সেন্টারে রয়েছে ৮৭২টি এবং সারা দেশের জেলা পর্যায়ের ১০টি অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া করে রাখা হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৮৬টি ইভিএম মেশিন। সেগুলোর সবই পুরোপুরি কার্যকর। সেগুলো দিয়ে নির্বাচন করা যাবে। ইভিএমগুলো যেহেতু ইলেকট্রনিক ডিভাইস, তাই সেগুলো সচল রাখতে নিয়মিত রিচার্জ করাসহ পরিচর্যার জন্য জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ পরবর্তী সব ভোটেই ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত পাঁচ বছরে কতগুলো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক রাকিবুল হাসান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনসহ সব নির্বাচনেই আমরা ইভিএম ব্যবহার করেছি। ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩৭০টি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে একাদশ সংসদীয় সাধারণ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ভোট হয় ইভিএমে।
অন্য নির্বাচনগুলোর (উপনির্বাচনসহ) মধ্যে রয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের ২৫টি শূন্য আসনে উপনির্বাচন, ১২টি সিটি করপোরেশন, ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচন, ২২০টি পৌরসভা, ৩৪টি উপজেলা পরিষদ এবং এক হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জেলা পরিষদের ভোটে ৯৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ভোট পড়ে একাদশ জাতীয় সংসদের ২৫টি শূন্য আসনের উপনির্বাচনে (২৮.০৫%)।
এবারের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ইসির ঘোষিত নির্বাচনী রোডম্যাপে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা জানানো হয়। এ জন্য ত্রুটিপূর্ণ ইভিএম মেরামত এবং নতুন করে দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প তৈরি করে ইসি। ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ওই হিসাব দেখে বাদ সাধে তারা। প্রকল্পটি এডিপির তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়।
পরের একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা সচিব জানান, নতুন করে প্রকল্প প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। পরে সরকারের বাজেট সংকোচন নীতির কারণে সর্বশেষ ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ওই পদ্ধতিতে ভোটের পরিকল্পনা থেকেও সরে আসে সংস্থাটি।
চলতি বছরের ৩ এপ্রিল কমিশন সভা শেষে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম গণমাধ্যমকে জানান, এবার কোনো আসনেই ইলেকট্রনিক ইভিএম মেশিনে ভোট না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ৩০০ আসনেই ভোট গ্রহণ হবে ব্যালট পেপার ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী রোডম্যাপে আমরা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। এই লক্ষ্য ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই প্রকল্পটি অনুমোদন করেনি। অন্যদিকে বিদ্যমান ইভিএম সংস্কারে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সেই টাকা দিতেও অর্থ মন্ত্রণালয় অপারগতা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম নিয়ে ঐকমত্যের অভাব ছিল। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’