![হুঁশিয়ারির পরও কমছে না নিত্যপণ্যের দাম](uploads/2024/02/07/1707277361.market.jpg)
ভোটের পর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন। ২০ দিন চলে গেলেও বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। রমজান মাস ঘনিয়ে এলেও কমছে না চাল, পেঁয়াজ, ডিম, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম। সরকার পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা কেজি বেঁধে দিলেও বাজারে ১০০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, বিদেশ থেকে আমদানি ছাড়া কমবে না এর দাম। বেশি করে ধান, চাল মজুত করায় কমছে না চালের দাম। সব নিত্যপণ্যই ভোক্তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছেন। ভোক্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বলছেন, সরকারকে আরও বেশি করে রাইসমিল, আড়ত, পাইকারি ও খুচরা বাজার কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। তবেই কমবে পণ্যের দাম।
মঙ্গলবার (৬ জানুয়ারি) বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সূত্র জানায়, দেশে সারা বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো। তবে রমজানে পেঁয়াজের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। প্রায় ৫ লাখ টন লাগে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেও ভারত আমদানি বন্ধ ঘোষণা করায় দেশে বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। বর্তমানে ১০০ টাকার কম বিক্রি হচ্ছে না।
পেঁয়াজের দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল কারওয়ান বাজারের মিনহাজ ট্রেডার্সের খলিল ও কুতুবপুর বাণিজ্যালয়ের কালাম শেখ খবরের কাগজকে বলেন, আড়তেই ৮৫-৯০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কৃষি মার্কেটের লিটন শেখও জানান, বর্তমানে ৮৫-৯০ টাকা কেজি। পেঁয়াজ আমদানি না করলে কমবে না দাম। সামনে আরও দাম বাড়বে। কারণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ শেষ পর্যায়ে। হালিকাটা (সিজনের পেঁয়াজ) আসতে আরও মাসখানেক লাগবে। আবার রমজান মাসও ঘনিয়ে আসছে।
আড়তের সেই পেঁয়াজ পাইকারদের হাতবদল হয়ে খুচরা পর্যায়ে ৯৫-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টাউন হল বাজারের সবজি বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। ১০০ টাকা কেজি। এত দাম কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই খুচরা বিক্রেতা বলেন, মোকামে বাড়ছে দাম। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি বেশি না হলে সামনে আরও দাম বাড়বে। ভারত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করলে হঠাৎ করে বাড়তে থাকে দাম। সরকার বাধ্য হয়ে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর দেশি পেঁয়াজের কেজি ৬৫ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বিক্রি হয় অনেক বেশি দামে। কেজি ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এরপর মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠলে ৮০ টাকায় নামে। আবার বেড়ে ১০০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এ সময় শফিকুল ইসলাম নামে এক চাকরিজীবী বলেন, এভাবে চলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিন্তু ২০ দিন চলে গেলেও কোনো পণ্যের দাম কমেনি। সরকারকে আরও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে।
আলুর ভরা মৌসুমেও কমছে না দাম। গত বছরের এই সময়ে ২০-২৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হলেও গতকাল ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। টাউন হল বাজারের খুচরা বিক্রেতা রফিকসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা বলেন, দাম বেশি। ৩৫-৪০ টাকা কেজি। অথচ সরকার অনেক আগে এর দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা বেঁধে দেয়।
কয়েকটা কোম্পানি সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম গত বছরের আগস্টে হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেয়। তা বাড়তে বাড়তে ১৭০ টাকা ডজন ঠেকে। এ নিয়ে হইচই পড়লে অনেক পরে পেঁয়াজ, আলুর সঙ্গে ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৪৪ টাকা ডজন বেঁধে দেয়। তার থেকে কম দামেই ১২৫-১৩০ টাকা ডজন ডিম বিক্রি হয়। কিন্তু নিয়ম অমান্য করে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি করায় ডায়মন্ড এগ লিমিটেড ও সিপি বাংলাদেশ কোম্পানিকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। এই দুই কোম্পানিকে সাড়ে তিন কোটি টাকা জরিমানা করার পরই আবার বেড়ে গেছে ডিমের দাম। বর্তমানে ১৪০-১৪৪ টাকা ডজন বিক্রি করা হচ্ছে বলে বিক্রেতারা জানান।
এদিকে মুরগির দামও কমেনি। আগে পোলট্রি মুরগি ১৭০-১৮০ টাকা কেজি বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ১৯০-২০০ টাকার কমে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানি মুরগিও আগে ২৮০-২৯০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বিভিন্ন বাজারে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের বাংলা চিকেন হাউস ও টাউন হল বাজারের ব্রয়লার হাউজের বিল্লাল বলেন, ‘দাম কমে না। জরিমানা করার পরই ডিমের দাম বেড়ে গেছে। মুরগির দামও বাড়ানো হয়েছে। তাই আমাদের বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।’
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বিভিন্ন বাজারে অভিযানে গেলেও চালের দাম কমেনি। এখনো মিনিকেট ৬৮-৭০ টাকা, আটাশ চাল ৫৫-৫৮ টাকা ও মোটা চাল ৪৮-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন বাজারে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। তারপরও বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমেনি।
রমজান মাসে চিনির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সারা বছরে ২০ লাখ টন লাগে। প্রতি মাসে দেড় লাখ টন লাগলেও রমজানে দ্বিগুণ লাগে। অন্যান্য পণ্যের মতো আগে থেকেই বেড়ে গেছে এর দাম। ডলারের অজুহাতে গত ১৩ আগস্ট দেশের বাজারে চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। খোলা চিনি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারও সেই দাম ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাজারে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। কোনো কোনো বাজারে ১৪৫-১৫০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দেশে বছরে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টন তেল আমদানি হয়। এর মধ্যে রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টন। রমজান মাস ঘনিয়ে এলে ডলারের অজুহাতে গত ডিসেম্বরে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রতি লিটার ১৭৩ টাকা ও ৫ লিটার ৮৪৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে বলে কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের ইউসুফ ও ইয়াসিন স্টোরের করিম ব্যাপারীসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা জানান।
রমজান মাসে ইফতারিতে ছোলাও বেশি লাগে। দেশে ছোলার চাহিদা দেড় লাখ টন। তবে রমজানে ১ লাখ টনের মতো লাগে। অন্যান্য পণ্যের মতো এই পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। আগে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও বিভিন্ন অজুহাতে সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে ১১০-১২০ টাকা কেজি হয়ে গেছে। কারওয়ান বাজারের আল আমিন স্টোরের সোহরাব বলেন, ছোলার দাম আগেই বেড়ে গেছে। কমছে না। বর্তমানে ১১০-১২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
বছরে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টন খেজুর লাগলেও রমজানে চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। প্রায় ৫০ হাজার টন লাগে। কিন্তু কয়েক মাস থেকে বেড়ে গেছে খেজুরের দাম। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, মান ভেদে ৫০-৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে দাম। কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ভ্যারাইটিজ স্টোরের আওলাদ বলেন, সব খেজুরের দাম আগেই বেড়ে গেছে। বর্তমানে বস্তার জাহেদী খেজুর কেজিতে ২২০ টাকায়, তিউনেশিয়ার খেজুর ৫০০-৫৫০ টাকায়, আম্বার ও মরিয়ম খেজুর ১২০০ টাকায় ও আদম খেজুর ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্য খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, রমজানের আগেই গত বছরের চেয়ে খেজুরের অনেক বেশি দাম বেড়ে গেছে।
অন্যান্য পণ্যের মতো আদা, রসুনের দামও কমছে না। বর্তমানে বিভিন্ন বাজারে রসুন কেজিতে ২০০-২১০ টাকায় ও আদা ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শসার দামও বেড়ে গেছে। ইফতারির জন্য এই প্রয়োজনীয় পণ্যটি এখনই কেজিতে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শীতের ভরা মৌসুমেও বেগুনের কেজি ৬০-১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। এ সময় সোহবুল নামে এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখনো রমজান মাস আসতে দেড় মাস বাকি। তারপরও বেগুনের এত দাম। সরকারের কঠোরভাবে বাজার অভিযান করা দরকার। তা না হলে কমবে না দাম।