উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ আরও সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেই লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা-২০১৩-এর কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আনতে একটি প্রস্তাবিত খসড়া তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়।
এই সংশোধনী প্রস্তাবনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে বিদ্যমান ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার বিধান বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এই সুযোগে উপজেলা নির্বাচনে ভুঁইফোড় প্রার্থীদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে জামানত কয়েক গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে জামানত বাজেয়াপ্তের বিধানেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নির্বাচনে যে-সংখ্যক ভোট পড়বে, তার ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রদত্ত ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান রয়েছে।
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়। ইসি সূত্রে আরও জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালাতেও ব্যাপক সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রচারের সুযোগ দেওয়া এবং নির্বাচনি প্রচারের পোস্টারে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচারের বিষয়টি বিধিমালার আওতায় আনা হচ্ছে। জনসভা ও মিছিলের আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে মাইক ব্যবহারে শব্দের মানমাত্রাও বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নির্বাচনি প্রচারে রঙিন পোস্টার ও ব্যানার ব্যবহারের সুযোগ আবারও ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে গত বুধবার কমিশনের ২৭তম সভায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালার সম্ভাব্য সংশোধনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এবং সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করে ইসি সচিবালয়। পরদিন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার নেতৃত্বাধীন ‘আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি’র বৈঠকে ওই সব সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। পরে কমিটির পক্ষ থেকে উল্লিখিত প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে তা চূড়ান্ত করতে সুপারিশ কমিশন সভার জন্য পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা এবং উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালায় কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব রয়েছে। ওই সব প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে আইন সংস্কার কমিটি। ওই কমিটির সুপারিশ কমিশন সভায় তোলা হবে।
বুধবার দুপুরে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সব রাজনৈতিক দলকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এ সময় আইন সংশোধন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ইসি আলমগীর বলেন, ‘আমরা আসলে কোনো আইন সংশোধন করতে চাইনি। আচরণ বিধিমালায় কিছু জায়গায় অসঙ্গতি আছে, কিছু অস্পষ্ট আছে; এগুলো যারা প্রয়োগ করতে চান তারা ফিডব্যাক দিয়েছেন, সেই ফিডব্যাকের পর এগুলো পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। সে ব্যাপার যেহেতু আচরণবিধিমালা শুধু নির্বাচন কমিশন সংশোধন করতে পারে, এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের একটা ভোটিং লাগে, সেটা পেলে আমরাই জারি করতে পারি।’ আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়েও ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
নির্বাচন বিধিমালা সংশোধন
ইসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা জানা যায়, দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট হওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৬ সালে ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা সংশোধন’ করা হয়। তখন থেকে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইয়ের তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। এই সই জমা দেওয়ার বিধানের কারণে অনেকেই প্রার্থী হতে পারেন না। আবার ওই তালিকার গরমিল, স্বাক্ষরদাতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তা অস্বীকার করানোসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে প্রার্থিতা বাতিলের অনেক নজির রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিধিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে কমিশন। এতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালার বিধি ১৫-তে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে, প্রার্থিতার সমর্থনে সইযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার ফলে ভোটারদের গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে জানিয়েছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা দলীয় কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে না। দল-সমর্থিত প্রার্থীরাও স্বতন্ত্রভাবে ভোট করতে পারবেন।
জাতীয় সংসদের আদলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও কিছু বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচন বিধিমালার ৮০-‘ক’ বিধিতে নির্বাচনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের হুমকি, ভীতি ও বাধা দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অনিয়ম ও প্রভাব বিস্তার হলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে বিধিতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। নির্বাচন বিধিমালায় আরও যেসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- কেবল অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিল, নির্বাচনি ব্যয়সীমা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং নির্বাচন প্রচার মনিটরিংয়ে কমিটি গঠন করা।
এর আগে কমিশনের মঙ্গলবারের সভায় উপজেলা পরিষদগুলোতে চার ধাপে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসির ঘোষণা অনুযায়ী, এবারের উপজেলা পরিষদের এই ভোট আগামী ৪ মে শুরু হয়ে শেষ হবে ২৫ মে। প্রতি ধাপে শতাধিক উপজেলায় ভোট হবে। যেসব উপজেলার মেয়াদ আগে শেষ হবে, সেগুলোতে আগে ভোট হবে- এই নীতি অনুসরণ করা হবে।
বিগত উপজেলা নির্বাচনের মেয়াদকাল বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত তফসিল শিগগিরই ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। তথ্য অনুযায়ী, ৪৮৩টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপযোগী রয়েছে। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হয় ২০১৯ সালের ১০ মার্চ। পাঁচ ধাপের ওই ভোট শেষ হয় ওই বছরের জুনে।