![আটকে আছে বিপুল বিদেশি ঋণ](uploads/2024/02/10/1707542047.debt.jpg)
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহৃত বিদেশি ঋণের পাহাড় জমেছে পাইপলাইনে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে গত এক দশকে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাইপলাইনে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ আটকে রয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী দেশীয় মুদ্রায় এর অঙ্ক প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে অন্তত ১৫টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন সংস্থার কাছে এই টাকা দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর অদক্ষতা, দুর্বল তদারকিসহ নানা কারণে বিশাল ওই পরিমাণ টাকা আটকে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে।
ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাইপলাইনে বিদেশি ঋণ আটকে থাকবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ একটি ঋণচুক্তি সই হওয়ার পর তা পাইপলাইনে চলে আসে। আমাদের দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ তিন থেকে পাঁচ বছর। এই ঋণ ছাড় হতে আরও বেশি সময় লাগে। প্রকল্পের মেয়াদ সময়মতো শেষ না হওয়ার কারণেই পাইপলাইনে টাকার পাহাড় জমেছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রিজার্ভের এই দুর্দিনে পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশি সহায়তা বা ঋণের দ্রুত ছাড়ের উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থ ছাড় দ্রুত হলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকে মজুত রিজার্ভে স্বস্তি ফিরবে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারের নিচে। তবে নিট রিজার্ভ আরও কম।
ইআরডির পরিসংখ্যানে অনুযায়ী, গত অর্থবছরে পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। আলোচ্য অর্থবছরে এটি ছিল ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৮ দশমিক ৮২ কোটি ডলার।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং লেনদেনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের যথাযথ ব্যবহার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই রকম কমিটি আগেও হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হলে কমিটিকে তৎপর হতে হবে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে একটি সাব-কমিটি করতে হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র সাব-কমিটির কাছে রিপোর্ট করতে হবে। এখানে উন্নয়ন সহযোগীদের (যারা ঋণ দিচ্ছে) যুক্ত করতে হবে। দুই পক্ষের কথা শুনতে হবে। অর্থায়ন যদি বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের কথা শুনতে হবে। এডিবির হলে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে দ্রুত অর্থ ছাড় সম্ভব।
বর্তমানে উন্নয়ন বাজেট বা এডিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ জোগানের বড় একটি অংশ আসে বিদেশি ঋণ থেকে। ‘বৈদেশিক সহায়তার পুষ্ট’ প্রকল্পে এ অর্থ ব্যবহৃত হয়। এডিপিতে মোট প্রকল্পের ৩০ শতাংশ হচ্ছে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প। সে হিসাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থার অধীনে প্রায় চার শতাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বেশি হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। তারপর রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। দ্বিপক্ষীয় দেশের মধ্যে ভারত, চীন, জাপান ও রাশিয়া থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অন্য দেশ থেকেও ঋণ নেওয়া হয়। তার পরিমাণ কম। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তা নমনীয়। সুদহার কম ও পরিশোধের মেয়াদ ৩০ থেকে ৪০ বছর। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় দেশের মধ্যে চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণের শর্ত কঠিন এবং পরিশোধের সময় কম থাকে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী শফিকুল আযম খবরের কাগজকে বলেন, ‘পাইপলাইনে জমে থাকা ঋণ দ্রুত ছাড় করতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে। যেসব ঋণচুক্তি হয়, তার ২০ শতাংশ অর্থ ছাড় হলে বলা যায় ভালো চিত্র। কিন্তু এর কম হলে পাইপলাইনে জমার পরিমাণ বাড়বে। সমাধানের মাত্র একটি পথ আছে। তা হলো: প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময়মতো শেষ করা। কারণ প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হলে খরচ বেড়ে যায়। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়াই পাইপলাইনে আটকে থাকার প্রধানতম কারণ।’
ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ওই দেশের সঙ্গে চুক্তি সই হলেও এ পর্যন্ত অর্থ ছাড় খুবই কম হয়েছে। সে জন্য পাইপলাইনে আটকে আছে বিপুল পরিমাণ ঋণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বছরে ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার ছাড় হলে (ডিসবার্সমেন্টে) পাইপলাইনে ৪০ বিলিয়ন (৪ হাজার কোটি ডলার) আটকে থাকটা অস্বাভাবিক নয়।’
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এক দশক আগে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ দেশে আসত, এখন তা বেড়ে দ্ধিগুণ হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১ কোটি ডলার ঋণ এসেছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি বেদিশে ঋণ এসেছে ২০২১-২২ অর্থবছরে। এর পরিমাণ প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর এসেছে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
সেন্ট্রার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পাইপলাইনে বিশাল অঙ্কের বিদেশি ঋণ আটকে রয়েছে। রিজার্ভের এই দুর্দিনে জমে থাকা ঋণ দ্রুত ছাড় করাতে পারলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্য ও রিজার্ভে স্বস্তি আসবে।’ বিদেশি ঋণ দ্রুত ছাড় করার জন্য বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি।
বিদেশি ঋণ শোধে চাপ আরও বাড়ছে
চলমান ডলারসংকটের মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া কঠিন শর্তের অনেক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ কারণে দ্রুত বাড়ছে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ, যা আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ বাড়ছে এমন সময়ে, যখন দেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলারসংকটের মধ্যে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে। কারণ প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত হারে আসছে না। রপ্তানি আয়ও আশানুরূপ নয়। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১০ বছর আগে বছরে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করত, এখন পরিশোধ করতে হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, যদি সরকার নতুন করে আর বিদেশি ঋণ না নেয়, তার পরও সাত বছর পর ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হবে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) গত ছয় মাসের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সুদ ও আসল মিলিয়ে ১৫৬ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
ইআরডির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন বা ২৬৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৬১ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩২৯ কোটি ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭৩ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির সাবেক সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, ‘মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ ২০২৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ফলে আগামীতে পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বছরে বাড়তি ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিশোধে চাপ বেড়েছে। আবার ঋণপ্রবাহ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হওয়ায় সে অনুপাতে পরিশোধের চাপও বেড়েছে।