সমাজের ধনী-দরিদ্র সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখে কেনাকাটা করেন। উৎসব উদযাপনে তারা কিনেন পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল, প্রসাধনী, জুয়েলারি, খাদ্যসহ নানাবিধ পণ্য। এবার ঈদুল ফিতরের দুই দিন পরই পহেলা বৈশাখ- অল্প ব্যবধান বড় দুই উৎসব। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যে তাই কেনাকাটায় রয়েছে হতাশা, বাধ্য হয়ে অনেকেই বাজারের ফর্দে কাটছাঁট করছেন।
সরেজমিনে বাজার ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার ডলারসংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীদের অনেকে এলসি খুলে পণ্য আমদানির সুযোগ পায়নি। এতে চাহিদার তুলনায় পণ্য আমদানি কম হয়েছে। আর যাও বা আমদানি হয়েছে তা বেশি দামে কিনতে হয়েছে। ন্যূনতম লাভে বিক্রি করা হলেও দাম বেশি পড়ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম আরও বেড়েছে।
সাধারণ মানুষের অনেকেই জানিয়েছেন, বছর খানেক ধরে আয় বাড়েনি বললেই চলে। প্রতি দিনের খরচ চালাতে ধারদেনা পর্যন্ত করতে হচ্ছে। একটি উৎসবের কেনাকাটা করার মতো বাজেট নেই। সেখানে পর পর দুই উৎসব উদযাপনের কেনাকাটা করার মতো অর্থ কোথায়? বিশ্লেষকরা বলেছেন, দুই উৎসবকেন্দ্রিক প্রায় সব ধরনের কেনাকাটায় এবারে গড়ে ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ বা তার বেশি খরচ বাড়বে।
দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন খোদ ব্যবসায়ীরাও। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারসংকট দেখা দিয়েছে। এতে পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরে যেসব জিনিস বেশি বিক্রি হয় তার প্রায় সব কিছুই বেশি দামে সংগ্রহ করতে হয়েছে। ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও দাম অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। তবে এটাও ঠিক- দাম যতটা বাড়ার কথা, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন। এতে সৎ ব্যবসায়ীরা চাপে পড়ছেন। ক্রেতার ভোগান্তি বাড়ছে। দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে সরকারি নজরদারি বাড়ানো দরকার।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দামের কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। ঈদে ও পহেলা বৈশাখে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেসবের দাম রমজানের শুরু থেকই বেশি বেড়েছে। করোনার পর থেকে সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। এতে অধিকাংশ মানুষ দৈনিক খরচ চালিয়ে নিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এবারে দুই উৎসবের চাপ এক সঙ্গে পড়েছে। পরিবারের যিনি আয় করেন তার কাছে উৎসব ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে।’
বাজার ঘুরে দেখা যায়, অনেকে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উদযাপনে কেনাকাটা করলেও এবার করেননি। শুধু ঈদ উদযাপনে কেনার জন্য বাজেট করেছেন। তাও আগের বছরগুলোর চেয়ে কম। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, বিপণিবিতানে ক্রেতাদের আনাগোনা ততই বাড়ছে। তবে গতবারের চেয়ে এবার বেশি দামেই ঈদ পোশাক কিনতে হবে ক্রেতাদের। কারণ, ইতোমধ্যে গত বছরের তুলনায় পোশাকের দাম ১০-৩৫ শতাংশ বেড়েছে। গতবার যে পোশাকের দাম ১ হাজার টাকা ছিল এবার তা ১২/১৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বুটিক হাউস রঙের কর্ণধার সৌমিক দাশ খবরের কাগজকে বলেন, ‘কাপড়ের দাম, শ্রমিকের মজুরি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ সবকিছুর দামই বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রয়কেন্দ্রের খরচও বেড়ে গেছে। ফলে সব প্রতিষ্ঠানই বাধ্য হয়ে পোশাকের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানভেদে দাম বেড়েছে ভিন্ন ভিন্ন। ক্রেতাদের সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দাম যতটা না বাড়ালেই নয় ততটা বাড়াচ্ছি। তিনি বলেন, পোশাকের দাম ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে। কিছু পোশাকের দাম ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এজন্য অনেকে বৈশাখের কেনাকাটা না করে শুধু ঈদের কেনাকাটা করছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে বাজারে কেনাকাটা করতে আসা বেশির ভাগ ক্রেতার বাজেট গতবারের তুলনায় কম। অনেকে বলেছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বাড়লেও বাড়েনি আয়। তাই উৎসব উদযাপনের জন্য কেনাকাটার তালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অনেকে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদ দুই উৎসবেই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল, সাজসজ্জাসহ শখের জিনিসপত্র কিনলেও এবারে শুধু ঈদ উদযাপনের জন্য কিনেছেন। উৎসব ঘিরে যেসব জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ে তার অধিকাংশের দাম বেড়েছে এমন অভিযোগও করেছেন অনেক ক্রেতা।
নিউ মার্কেটে পরিবারের সদস্যদের জন্য পোশাক কেনার পর বেসরকারি চাকরিজীবী হাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সব খরচই বেশি। দুই দিনের ব্যবধানে পহেলা বৈশাখ ও ঈদ। অন্যবার এসব উৎসবে পরিবারের সবার জন্য জামা কাপড়. জুতা-স্যান্ডেলসহ এটা-ওটা কিনে দিয়েছি। এবার আর্থিক সংকটের কারণে পারব না। এবার শুধু সন্তানদের জন্য কেনাকাটা করব। পহেলা বৈশাখে আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের দাওয়াত করে খাওয়াতাম। এবারে এসব বাদ দেব।’
আর্থিকভাবে সচ্ছল ক্রেতারা বরাবরের মতো এবারেও এক দামের দোকানে যাচ্ছেন। তাদের পছন্দের তালিকায় ব্রান্ডের পণ্য রয়েছে। সাধারণ আয়ের বেশির ভাগ ক্রেতাই দোকানে দোকানে ঘুরে পছন্দের জিনিস দরদাম করে কিনছেন। বিক্রেতারা বলেছেন, এবারে বেশি দামের পণ্য এড়িয়ে তুলনামূলক কম দামের পণ্যের প্রতি আগ্রহ ক্রেতাদের।
বৈশাখ ও ঈদের আয়োজনে কম আয়ের মানুষের ঠিকানা ফুটপাত। এখানে রং বেরং এর শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন পোশাক চৌকি বা কাপড়ের ওপর রেখে বিক্রি করা হচ্ছে।
ফার্মগেটে ফুটপাতে বসে জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি করেন মো. রমজান। জুয়েলারি বিক্রি করেন শোন আলী। এসব বিক্রেতা হতাশা প্রকাশ করে খবরের কাগজকে বলেন, বৈশাখের জন্য কেনাবেচা কম। গতবারের মতো এবারও ঈদের কেনাকাটা নেই। আশায় আছি ঈদের ঠিক আগে বিক্রি বাড়বে।