![যাত্রার শুরুতে ভোগান্তি, পথে স্বস্তি](uploads/2024/04/08/1712593420.Eid_Journey.jpg)
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রেল, সড়ক, নৌপথে ঘরমুখী মানুষের ঢল নেমেছিল গতকাল সোমবার। বিকেল হতেই রাজধানীর তিনটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ফলে টিকিট পেতে বা যানবাহনসংকটের কারণে যাত্রার শুরুতে কিছুটা ভোগান্তি হলেও পথে তেমন ভোগান্তি ছিল না। আগের চেয়ে কিছুটা স্বস্তিতেই গন্তব্যে যেতে পেরেছেন যাত্রীরা।
ঈদযাত্রার শেষ পর্বে দক্ষিণবঙ্গের বাসের টিকিটের সংকট হলেও দূরপাল্লার অন্যান্য রুটে পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। এবার ঈদের ছুটি বেশ লম্বা হওয়ায় যাত্রীরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন বলেও জানা গেছে। বাস, রেল ও নৌযাত্রায় যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা নিরসনে যৌথভাবে কাজ করছেন সরকার ও পরিবহন-মালিকরা। পরিবহন খাতের মালিকদের ধারণা, আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবার ঈদযাত্রার অন্তিমলগ্নে বাস, রেল, নৌপথে যাত্রীদের তুমুল ভিড় দেখা যাবে।
সায়েদাবাদে টিকিট নেই, গাবতলীতে যাত্রী নেই
গতকাল সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট যেতে মানুষের ঢল নেমেছিল। দক্ষিণবঙ্গের টিকিটের জন্য যাত্রীদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় এদিন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বরিশাল ও খুলনাগামী গোল্ডেন লাইন, সাকুরা, হানিফ, ইমাদ, দোলা, বলেশ্বর, পালকি, ফাল্গুনী বাস কাউন্টারে যাত্রীরা জানান টিকিটসংকটের কথা। খুলনাগামী ইমাদ ও গোল্ডেন লাইনেরও সব টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে আগেই।
কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মীরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বরিশালের যাত্রী বৃদ্ধি বেড়েছে বহু গুণ। দ্রুত যাওয়ার কারণে লঞ্চযাত্রীরা এখন বাসে যাতায়াত করেন বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় বাসের ট্রিপ সংখ্যা ও বাস বাড়েনি। ফলে বরিশালের বাসের টিকিট আগেই শেষ হয়েছে।
ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সায়েম আহমেদ গতকাল সোমবার সকালে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বরিশালের গৌরনদী যাব। কিন্তু গোল্ডেন লাইন, হানিফ ও সাকুরা কাউন্টারের কোনো টিকিট নেই বলছে। যাত্রাবাড়ী থেকে লোকাল বাসে উঠব।’
হানিফ বাস কাউন্টারের মাস্টার মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘এবার বরিশালের যাত্রীদের চাপ প্রচণ্ড। গত দুই দিনের টিকিট বিক্রিও শেষ। বরিশালে যাওয়ার সময় যাত্রী আছে, আসার সময় ফাঁকা আসতে হয়। তার পরও আমরা ঈদ উপলক্ষে বাস ভাড়া বাড়াইনি।’ শ্যামলী এনআর ট্রাভেলস কাউন্টার ম্যানেজার সোহেল খান বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের সব টিকিট বিক্রি শেষ। তবে গত ৪০ বছরের তুলনায় এবার চট্টগ্রাম রুটে টিকিট বিক্রি একেবারেই কম।’
গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে এবার গাবতলীতে যাত্রীর চাপ সেভাবে নেই। তাদের ভাষ্যে, এবারের ঈদযাত্রায় আশানুরূপ যাত্রীর দেখা মেলেনি গাবতলীতে। দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীরা গুলিস্তান বা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে দ্রুত সময়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছেন। ফরিদপুরগামী সূর্যমুখী পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গাবতলী থেকে গেলে সময়ও লাগবে বেশি, ভাড়াও পড়বে বেশি। তাই ঈদের মৌসুমেও যাত্রীদের কোনো আধিক্য নেই।’
মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, রুটের ভাড়া ৩৪০ টাকা হলেও ঈদযাত্রায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। সৌখিন পরিবহন, ইমাম পরিবহন, আলম এশিয়া পরিবহনের বাসগুলোর কর্মীদের সঙ্গে যাত্রীদের বেশ দেনদরবারও হলো। তবে এনা পরিবহন সরকার-নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে বলে জানা গেছে। শেরপুরগামী যাত্রী মাওলানা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে এনা পরিবহনের বাসের টিকিট কেটেছি। এর পরও আবার ৪টি বাস যাওয়ার পর ৫ নম্বর বাসে আমাকে উঠতে হয়েছে। তাতেও সমস্যা নেই। অন্য বাসগুলো তো অনেক বেশি ভাড়া চাইছে।’
সাভারের বিভিন্ন গার্মেন্ট ও কারখানা ছুটি হওয়ার পর গতকাল বিকেলে সড়কে যাত্রীদের ঢল নামে। তবে যাত্রীদের অভিযোগ, সড়কে পর্যাপ্ত বাস নেই। যে কটি বাসে যাত্রীরা উঠতে পারছেন, তাতেও বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। গতকাল বিকেলে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সাভার হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক বাবুল হোসেন বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে গাড়ি ও যাত্রীর চাপ বেড়েছে। তবে এখনো যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও কোথাও ধীরগতি রয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছে।’
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রবেশদ্বার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে যানবাহনের চাপ না থাকলেও কাটাপথে (সরাসরি গাড়িতে নয় ভেঙে) যাত্রীর চাপ কিছুটা বেড়েছে। বিআইডব্লিউটিসি আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, ‘পাটুরিয়া ও আরিচা ফেরিঘাটে মোট ২২টি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। আশানুরূপ যানবাহন না আসায় ফেরিগুলো ঘাটে নোঙর করে রাখা হয়েছে। আর যারা আসছেন তারা অপেক্ষায় না থেকে স্বস্তিতে ফেরি পার হয়ে যাচ্ছেন। তবে গতকাল দুপুরের পর থেকে ঘাট এলাকায় দূরপাল্লার যানবাহনের চাপ না থাকলেও কাটাপথে আসা যাত্রীর চাপ বেড়েছে।’
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের চন্দ্রায় গতকাল সকাল থেকেই বেড়েছে গাড়ির চাপ। বেলা ১১টায় চন্দ্রায় গিয়ে দেখা যায়, গাবতলী, আশুলিয়া, বাইপাইল, সাভার ও নবীনগর এলাকায় যানজট পরিস্থিতি তৈরি হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা ছেড়ে যায়।
অন্যদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী বাজার, স্টেশন রোড, কলেজ গেট, গাজীপুর চৌরাস্তা, চান্দনা চৌরাস্তা, মাওনা চৌরাস্তা, জৈনাবাজারসহ মহাসড়কের পুরো অংশে যানজট নেই বলে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর আশরাফ জানান, উত্তরবঙ্গগামী ঈদযাত্রায় গতকাল তেমন ভোগান্তি ছিল না। এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার অংশে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা পরিবহনগুলো উত্তরবঙ্গের দিকে চলাচল করছে। ঢাকাগামী পরিবহনগুলো ভূঞাপুর-এলেঙ্গা আঞ্চলিক বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে ঢাকার দিকে চলাচল করছে। এতে যদিও পরিবহনগুলোর বাড়তি ১৫ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে যেতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল গতকাল সকালে জানান, ২৪ ঘণ্টায় সেতুতে ২৯ হাজার ৭৮০টি পরিবহন থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা টোল আদায় হয়েছে।
রেলেও স্বস্তির যাত্রা
ঈদে রেলযাত্রার ষষ্ঠ দিনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের মধ্যে ছিল স্বস্তি। এদিন পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস আধা ঘণ্টা দেরি করে স্টেশন ছাড়ে। আর লালমনিরহাটগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস আধা ঘণ্টার বেশি দেরিতে স্টেশন ছাড়ে। কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, ট্রেন দুটি দেরিতে এসেছিল ঢাকায়। তাই ঢাকা ছাড়তেও দেরি হয়েছে। তবে বাকি ট্রেনগুলো ছেড়ে গেছে নির্ধারিত সময়ে। একতা এক্সপ্রেসের ঠাকুরগাঁওয়ের যাত্রী আলামিন বলেন, ‘বাসেই বাড়ি যাই প্রতিবার। তবে আমার বাড়ির দূরত্ব এত বেশি। রাস্তায় যানজট হলে ভোগান্তির তো শেষ থাকবে না। তাই এবার ট্রেনে যাচ্ছি।’
গতকাল সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পরিদর্শন শেষে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমরা যদি একজন দালালকেও পাই, যার কারণে রেলের যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, ঈদ ঘিরে বিভিন্ন রেলস্টেশনে র্যাবের গোয়েন্দা কার্যক্রমসহ চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। খন্দকার মঈন বলেন, ‘অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও বাহিনীর সমন্বিত তথ্য হচ্ছে- এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের নাশকতা বা সহিংসতার তথ্য আমাদের কাছে নেই।’
লঞ্চগুলো ফাঁকা, আরামদায়ক ভ্রমণে ঘরমুখী যাত্রীরা
ঢাকা নৌবন্দরের পরিচালক আলমগীর কবির খবরের কাগজকে জানান, আজ (সোমবার) বিকেল থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের প্রচুর চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যাত্রীর চাপ থাকায় আজ আমাদের ১০০টি লঞ্চ চালাতে হচ্ছে। গত কয়েক দিনের তুলনায় আজকেই চাপ বেশি। আশা করছি, যাত্রীরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারবেন।’
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ঈদুল ফিতর খুবই সন্নিকটে। ঠিক এই মুহূর্তে আগের বছরগুলোতে সদরঘাট থেকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর ঘাটে লঞ্চ আসত। কিন্তু এ বছর চিত্র ভিন্ন। সব ধরনের প্রস্তুতি থাকলেও লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা খুবই কম। যাত্রীদের জন্য বাড়ি ফেরা হচ্ছে আরামদায়ক ভ্রমণ। স্বাভাবিক সময়ের মতো যাত্রী নিয়ে আধা ঘণ্টা পরপর লঞ্চগুলো ঘাটে ভিড়ছে। ঈদ উপলক্ষে এই রুটে ২৪টি বিলাসবহুল লঞ্চ চলাচল করছে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লঞ্চঘাটে অবস্থান করে রাজধানীর সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসা এমভি সোনারতরী, ময়ূর-২, এমভি মিতালী-৭ এবং বোগদাদিয়া লঞ্চের যাত্রীসংখ্যা খুবই কম দেখা গেল। চাঁদপুর ঘাট থেকে সদরঘাটের উদ্দশে যাত্রীর অপেক্ষায় আব-এ জমজম-৭ অপেক্ষমাণ দেখা যায়।
এমভি মিতালীর যাত্রী মফিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘অন্য বছর এই সময়ে লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা থাকত অনেক। সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে চাঁদপুরে এসেছি। তবে এবারের লঞ্চযাত্রা খুবই আরামদায়ক হয়েছে।’ তিনি চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী এলাকার বাসিন্দা।
ঢাকা থেকে আসা মতলব দক্ষিণের যাত্রী ফাহিমা বেগম জানান, সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে এসেছেন। এবারের যাত্রা খুবই আরামদায়ক হয়েছে। কোনো কষ্টই মনে হয়নি।
ঢাকায় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন শরীফ হোসেন। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে। তিনি বলেন, লঞ্চে ভ্রমণ আরামদায়ক হওয়ার কারণে সব সময় ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বাড়িতে যান। তবে এবার লঞ্চে কোনো ভিড় নেই, ভাড়াও আগের মতো।
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান দুপুরে লঞ্চঘাট পরিদর্শনে আসেন। এ সময় তিনি যাত্রী ও অটোরিকশাচালকদের মাঝে সতর্কতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন। তিনি বলেন, ‘ঈদে সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো যাতে চাঁদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, কোনো ধরনের ডাকাতি কিংবা অন্য ঘটনার শিকার না হয়, সে জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে। আমাদের পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। ঘাটে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ যাত্রীরা কোনো ধরনের হয়রানির অভিযোগ করলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।