ঢাকায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুসারে, রাজধানী ঢাকার দুই অংশে পানির চাহিদা প্রতিদিন দৈনিক গড়ে ২৬০ কোটি লিটার। ওয়াসার উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৯০ কোটি লিটার। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় দৈনিক ৩০ কোটি লিটার বেশি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ঢাকা ওয়াসার। অন্য সময়ে সংকট না থাকলেও প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে চাহিদা পূরণে বেসামাল হতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে। আবার যে পরিমাণ পানি উত্তোলন হয়, তার ৭৮ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে। বাকি ২২ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে বিভিন্নভাবে জোগাড় করা হয়। এমন অবস্থায় শুকনো মৌসুমে সংকটের পেছনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়া ও নানামুখী সিস্টেম লসকে দায়ী করা হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব বলছে, রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর প্রতিবছর দুই-তিন মিটার নেমে যাচ্ছে। এ তথ্যের কথা সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও বাড়বে। ঢাকা শহর কংক্রিটে ঢাকা পড়েছে। যে পরিমাণ পানি আমরা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করি, বৃষ্টি হলে কংক্রিটের কারণে সেই পরিমাণ বৃষ্টির পানি রিচার্জ হতে পারে না। বৃষ্টি হলে পানি মাটির নিচে যেতে পারে না।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে ঢাকা ওয়াসা যে মেগা প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছে, সেগুলো নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্পও তাদের হাতে নেই। সে হিসেবে এটি ভালো উদ্যোগ।’
আশঙ্কাজনক হারে নামছে রাজধানীর পানির স্তর
ঢাকা ওয়াসা বলছে, ৫০ বছর আগেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটারের মধ্যে ছিল। বর্তমানে ৮৬ মিটার নেমে গেছে। এভাবে নামতে থাকলে ঢাকায় একসময় পানি সরবরাহ করা দুরূহ হয়ে যাবে। সাম্প্রতিককালে প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (ভূতত্ত্ব) ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, ‘ঢাকায় ৫০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৮৬ মিটারে নেমে গেছে। দেশের কিছু এলাকায় বোরো মৌসুমে পানির স্তর নিচে নামলেও আবার বৃষ্টির সময়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। তবে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর শুধু নামছেই, কখনো আর উঠছে না।’
ঢাকা ওয়াসার পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে যেখানে ঢাকায় গভীর নলকূপ ছিল ৭৯৫টি, ২০২২ সালে সেটি ৯০৬টি। বর্তমানে ৯৬০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। ৯৬০টি গভীর নলকূপ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে দুই হাজারের বেশি গভীর নলকূপের অনুমোদন রয়েছে। গভীর নলকূপের সংখ্যা প্রতিবছর এভাবে বাড়তে থাকলে তা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ লক্ষ্য থেকে দূরে
রাজধানী ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া বন্ধে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির মাধ্যমে ১৭ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ তিনটি প্রকল্প নেয় ঢাকা ওয়াসা। প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, গন্ধর্বপুর প্রকল্প এবং সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ লক্ষ্য থেকে দূরে অবস্থান করছে।
তারা জানান, ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানির সংগ্রহ ২০২৫ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। এ জন্য এই প্রকল্প তিনটি হাতে নেওয়া। কিন্তু গত ১০ বছরে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ কমানো গেছে মাত্র ১০ শতাংশ। কাজেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমানো নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (আরপিঅ্যান্ডডি) ড. মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী গন্ধর্বপুরে ৫০ কোটি লিটার এবং সায়েদাবাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে আমাদের আরও ৫০ কোটি লিটার পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যমাত্রা আছে। এগুলো সমাপ্ত হলে ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পাওয়া যাবে।’
ঢাকা ওয়াসার এই প্রকল্প সম্পর্কে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে চারটি নদী। সেগুলো আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এখন ওয়াসা ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। এই প্রকল্পের পানির দামও তো অনেক বেশি হবে।’
ওয়াসার ১০ অঞ্চলের সব কটিতেই পানিসংকট
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ১০টি অঞ্চলেই কমবেশি পানির সংকট চলছে। প্রতিবারের মতো এবারের গ্রীষ্মকালেও পানিসংকট শুরু হয়েছে। শুধু সংকটই নয়, এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু ময়লা।
রাজধানীর ত্রিমোহনী, নন্দীপাড়াসহ অনেক এলাকায় দেখা গেছে, ঘণ্টা পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি পেতে ‘যুদ্ধ’ করছেন বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এমন চললেও কোনো পদক্ষেপ নেই ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে।
এ ব্যাপারে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ওমর সাদাত জানান, ‘বিশেষ করে উত্তর গুলশানের বাসিন্দারা বেশি পানির কষ্টে আছেন। উত্তর গুলশান অংশে একটি পানির পাম্প বসানো জরুরি। ওয়াসার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’
ঢাকা ওয়াসার ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সব কটিতেই কমবেশি পানির সমস্যা রয়েছে। অঞ্চল-২-এর নবাবগঞ্জ, ডুরি আঙুলি লেন, জাফরাবাদ ও কাঁটাসুর, অঞ্চল-৪-এর বড়বাগ, মণিপুর, আগারগাঁও ও মিরপুর-১২, জোন-৫-এর গুলশান-১, গুলশান-২-এর ৮৩ নম্বর সড়ক এবং মালিবাগ বাজার রোড এলাকায় তীব্র পানিসংকট এবং ময়লা পানির দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নাগরিকরা।
অঞ্চল-৬-এর বনশ্রীর এফ ব্লক ও নন্দীপাড়া, অঞ্চল-৭-এর রসুলপুর, পাগলা, শাহী মহল্লা, নুরবাগ, আদর্শনগর, নামা শ্যামপুর, নিশ্চিন্তপুর, দেলপাড়া, শান্তিধারা ও দৌলতপুর এবং অঞ্চল-১০-এর ইব্রাহিমপুর, পূর্ব শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১১-এর মদিনানগর, বাইগারটেক, মাটিকাটা এবং উত্তরা-১৫, ১৬, ১৭ নম্বর সেক্টরে পানির সমস্যা রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার ওয়েসবাইটে একটি নোটিশ টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা ওয়াসার সম্মানিত গ্রাহকবৃন্দের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমানে সারা বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবহমান তীব্র তাপদাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বা শরীরে পানিশূন্যতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ঢাকা মহানগরীর জনবহুল পয়েন্টগুলোতে খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা (বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা)। আপনার প্রয়োজনে ঢাকা ওয়াসার পানি সেবা আপনার পাশেই থাকছে। ঢাকা ওয়াসা- সদা আপনার সেবায় নিয়োজিত।’