![প্রোটিয়াদের চোকার্স তকমা ঘুচবে এবার?](uploads/2023/11/03/1698998921.S-Africa.jpg)
১৯৯২ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর থেকেই নিয়মিত এর অংশ হয়ে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতি আসরেই তুমুল সম্ভাবনা জাগিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিলেও দিনশেষে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাপ্তি কেবলই হতাশা। বিশ্বকাপের বাইরে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সর্বদাই ফর্মে তুঙ্গে থাকা প্রোটিয়ারা বিশ্বকাপে এলেই যেন হারিয়ে খুঁজতে থাকে নিজেদের। এখন পর্যন্ত (২০১৯ পর্যন্ত) কোনো বিশ্বকাপের শিরোপা তো দূরে থাক পা দিতে ব্যর্থ বিশ্বকাপের ফাইনালে।
নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই (১৯৯২) সেমিফাইনালে পা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু সেবার সেমিফাইনাল থেকে তাদের বিদায়ের প্রক্রিয়াটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আফ্রিকার জিততে তখন প্রয়োজন ৭ বলে ২২। আকস্মিক বৃষ্টির বাধায় খেলা বন্ধ থাকে ১০ মিনিট। বৃষ্টি থামলে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির হিসাবটা পুরোপুরি বিপক্ষে যায় প্রোটিয়াদের। বৃষ্টির পর মাঠে নামার আগেই নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের পরাজয়। ৭ বলে ২২ রানের পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে দাঁড়ায় ১ বলে ২২ রানের লক্ষ্য। এক বৃষ্টিতেই মৃত্যু ঘটে প্রথম বিশ্বকাপেই তাদের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন।
ভারত ও পাকিস্তানে বসা ১৯৯৬ বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের যাত্রার ইতি ঘটে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারার শতকে। উইন্ডিজদের ছুড়ে দেওয়া ২৬৫ রানের লক্ষ্য তিন বল আগেই অলআউট হয়ে ১৯ রানে পরাজিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। অনেকের মতে, করাচির পেস স্বর্গের উইকেটে অ্যালেন ডোনাল্ডকে না খেলিয়ে পল অ্যাডামসকে খেলানো ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ভুলের খেসারতই নাকি তারা দিয়েছিল ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শন পলকের ৫ ও অ্যালেন ডোনাল্ডের ৪ উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ২১৩ রানে বেধে ফেলার পরেও সে ম্যাচ জিততে পারেনি প্রোটিয়ারা। পেন্ডুলামের মতো ঘুরতে থাকা ম্যাচ ৪৯.২ ওভারে গিয়ে হয়ে যায় ড্র দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ দুই ব্যাটার অ্যালান ডোনাল্ড আর ল্যান্স ক্লুজনারের ভুল বোঝাবোঝিতে রান আউট হয়ে। সে ম্যাচ ড্র হলেও নেট রান রেটে পিছিয়ে থাকায় আরেকবার ফাইনালের মঞ্চ থাকে প্রোটিয়াদের জন্য অস্পর্শ।
টানা তিন বিশ্বকাপে হৃদয় ভাঙার পর ২০০৩ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে বিশ্বকাপের সহআয়োজক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। কিন্তু ঘরের মাঠেও হতাশ হতে হয় তাদের। এবার বাদ পড়তে হয় গ্রুপপর্ব থেকেই। ৬ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে বি গ্রুপের পঞ্চম স্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ হয় নকআউটে পা দিতে না পারার ব্যর্থতায়। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে বরাবরই দুর্দান্ত ফর্মে থাকা প্রোটিয়ারা এভাবে বারবার বড় মঞ্চে হোঁচট খাওয়ায় ততদিনে নামের পাশে লেগে যায় ‘চোকার্স’ তকমা।
বারবার ব্যর্থ হতে হতে ক্লান্ত আফ্রিকানরা আরেকবার সেমিতে পৌঁছায় ২০০৭ বিশ্বকাপে। কিন্তু আরেকবার রচিত হয় স্বপ্ন ভাঙার গল্প। শন টেইটের পেইস আর ম্যাকগ্রার সুইংয়ের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে যায় প্রোটিয়া ব্যাটিং স্তম্ভ। মাত্র ১৪৯ রানে অলআউট হয়ে ম্যাচ হারতে হয় ৭ উইকেটে।
২০১১ সালে গ্রুপ পর্বে সে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে আভাস দিয়েছিল এবার প্রথা ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়ার। কিন্তু বিধি বাম! কোয়ার্টার ফাইনালে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই পুরোনো রোগে আক্রান্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিউইদের ২২১ রানে গুটিয়ে দিয়ে নিজেরাই গুটিয়ে যায় লক্ষ্য থেকে ৪৯ রান দূরে থাকতে ১৭২ রানে। নকআউটের বাধা পেরোনো যেন দুর্ভেদ্য এক কাজ হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য।
২০১৫ বিশ্বকাপকে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সেরা আফসোস বা আক্ষেপের বিশ্বকাপ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তারকা ঠাসা প্রোটিয়ারা দাপটের সঙ্গেই পৌছায় সেমিতে। এর আগে কোয়ার্টারে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো নকআউট বাধা টপকে যায়। কিন্তু স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিতে ফিল্ডিং ব্যর্থতায় অকল্যান্ডে আরেকবার সমাধি ঘটে তাদের ফাইনালে পা রাখার স্বপ্ন। ডি ভিলিয়ার্স, ডি কক, বেহারডিনের মতো দুর্দান্ত ফিল্ডাররা সেদিন সবাই যোগ দেন ক্যাচ ও রানআউট মিসের মিছিলে। আর তাতেই সে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল নিয়েও ব্যর্থ হয় তারা। মাঠ ছাড়তে হয় অশ্রুসিক্ত নয়নে।
আগের আসরের স্মৃতি ভুলে ইংল্যান্ডে নতুন আশায় বুক বাধার চেষ্টায়ও ব্যর্থ ফাফ ডু প্লেসিসরা। কিন্তু প্রথম ৫ ম্যাচের তিনটিতেই হার ও জয়ের মুখ দেখে একটিতে। একটি ম্যাচ হয় বৃষ্টিতে পণ্ড। প্রথম চার ম্যাচের একটি হারে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ডু প্লেসিসের মতে, ২০১৯ সালের সে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই যাত্রা থেমে যাওয়ার মূল কারণ বাংলাদেশের বিপক্ষে হার।
কিন্তু এবারের দক্ষিণ আফ্রিকা দল ২০১৫ সালের দলের চেয়েও দুর্বার ও দুরন্ত ডাচদের বিপক্ষে অঘটনের শিকার হওয়ার পরেও। এখন পর্যন্ত নিজেদের ৭ ম্যাচে ৬টিতেই জয়লাভ করেছে তারা। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে অবস্থান করছে (ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগ পযর্ন্ত)। স্বাগতিক ভারতও আছে তাদের পেছনে। ডি কক, ক্লাসেন, মার্করাম ও মিলারদের আগুন ব্যাটিংয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। কুইন্টন ডি কক চার শতকে ৫৪৫ রান করে ব্যাটারদের মধ্যে সবার উপরে অবস্থান করছে চলতি বিশ্বকাপে। বল হাতে জানসেনও আছেন জাম্পা ও শাহিন আফ্রিদির সঙ্গে যৌথভাবে ১৬ উইকেট নিয়ে শীর্ষে। ১১ উইকেট নিয়ে তালিকায় আরও আছে রাবাদা ও কেশভ মহারাজ।
আগে ব্যাটিং করে এবারের বিশ্বকাপে কখনোই তিনশোর নিচে রান করেনি আফ্রিকা। এর মধ্যে চার শ করেছে একবার। ৩৫০-এর বেশি করেছে তিনবার। প্রতিটি ম্যাচ তারা জিতেছে বিশাল ব্যবধানে। ১০২ রানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, ১৩৪ রানে অস্ট্রেলিয়া, ২২৯ রানে ইংল্যান্ড, ১৪৯ রানে বাংলাদেশ এবং ১৯০ রানে হারায় নিউজিল্যান্ডকে।
শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে এক উইকেটের ক্ষুদ্র জয় পেয়েছে তারা। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা সেই ম্যাচে জেতার অবস্থান থেকেও পরাজয়ের শঙ্কায় চলে গিয়েছিল তারা। শেষ পর্যন্ত শেষ উইকেটে রুদ্ধশ্বাস জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এর পূর্বে বিশ্ব আসরে কখনোই এমন নার্ভ গেমে তাদের সাবলীল থাকতে দেখা যায়নি। আর এটাই হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে অন্যবারের চেয়ে তারা কেন এবার আলাদা। এবারই কি তাহলে আরাধ্যের শিরোপা জিতে চোকার্স তকমা ঘুঁচাতে পারবে বাভুমা শিবির।