![প্রথম নারী শাসক রাজিয়া সুলতানা](uploads/2024/07/03/a3-1719987920.jpg)
দেশ শাসনের দায়িত্বভার একজন নারীর কাছে, এখন এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আরও হাজার বছর আগে একজন নারী সিংহাসনে বসছেন এবং দেশ পরিচালনা করছেন এটা মোটেই কোনো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। বলছি ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক রাজিয়া সুলতানার কথা। রাজিয়ার প্রকৃত নাম ছিল রাজিয়া উদ দুনিয়া ওয়া উদ্দিন। তার জন্ম ১২০৫ সালে। ইলতুৎমিসের কন্যা ছিলেন রাজিয়া। একাধারে একজন ভালো শাসক ও সেনাপতি হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তার দক্ষতা ছিল অনন্য।
সেই আমলে ভারতে মেয়েদের কোনো রাজনীতি করার কোনো অধিকার ছিল না। শৃঙ্খল ভেঙে প্রথমবার শাসক হয়েছিলেন রাজিয়া সুলতানা। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন রাজিয়া। শুধু তাই নয়, রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। যুদ্ধের প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা। পিতা ইলতুৎমিশ নিজ হাতে তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়েছিলেন, সঙ্গে রাজনীতিও। মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও যুদ্ধনৈপুণ্যে কৈশোরেই নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। তারুণ্যে তিনি নেতৃত্ব ও শাসকসুলভ দক্ষতায় পিতার আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। সময়টা ১২৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দ। রাজিয়া সুলতানার পিতা ইলতুৎমিস যখন গোয়ালিয়রে অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি দিল্লি শাসনের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি এত দক্ষতার সঙ্গে দিল্লির শাসনভার সামাল দিয়েছিলেন যে, তার পিতার অনুপস্থিতির সুযোগ কেউ নিতে পারেনি। সুলতান তখন থেকেই মেয়েটার প্রতি অসম্ভব মুগ্ধ এবং আশাবাদী। সুলতানের বড় পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পিতার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। ইলতুৎমিশ তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করে যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর একজন নারীর শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান দরবারের অভিজাতরা। আর তাই ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তারা তার ছোট পুত্র রাজিয়ার সৎভাই রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতায় বসান। রোকনউদ্দীন ফিরোজ ছিলেন চরম অযোগ্য একজন শাসক। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, রাজ্য চালনার চেয়ে গায়িকা আর নর্তকীদের সঙ্গে সময় কাটাতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আর এই সুযোগে রাজ্য চালাতে লাগলেন তার মা তুরকান খাতুন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। অযোগ্য শাসক রোকনউদ্দীন আর তার অনভিজ্ঞ মা তুরকান খাতুনের জন্য গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নেমে এল। এরপর অভিজাতদের কাউন্সিল তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন এবং রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে আরোহণ করেন।
নারী হিসেবে যেন কেউ তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে না দেখেন, সেজন্য সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতেন পুরুষদের অনুকরণে আলখাল্লা পরে। মাথায় পরতেন পাগড়ি। তিনি তাকে সুলতানা সম্বোধন করাটাও পছন্দ করতেন না। কারণ তার মতে সুলতানা হচ্ছে সুলতান অর্থাৎ শাসকের স্ত্রীর উপাধি। তিনি তো আর শাসকের স্ত্রী নন, বরং স্বয়ং একজন শাসক। তার শাসনকালে নিজের নামে মুদ্রা বের করেছিলেন তিনি।
পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন নারী অসম্ভব দক্ষতা এবং অসীম দৃঢ়তায় সব প্রতিকূলতা জয় করে অন্ধকার যুগে জ্বালিয়েছিলেন সাহসিকতার মশাল। ১২৩৬ সালের এই ঘটনায় শুধুই পাক-ভারত এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইতিহাস নয়, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে একজন রমণীর এমন বিস্ময়কর উত্থান আজও অমলিন। রাজিয়া তার সময়ে জনগণের জন্য অনেক স্কুল, গবেষণাকেন্দ্র, লাইব্রেরি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় দিল্লির সর্বত্র তুর্কিদের প্রভাব প্রতিপত্তি থাকায় সুলতানা রাজিয়াকে সবাই নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে প্রায় চার বছর ধরে গোটা সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন রাজিয়া সুলতানা। অবশেষে ১২৪০ সালের ১৫ অক্টোবর একটি যুদ্ধে তিনি মারা যান।
জাহ্নবী