তিনি একই সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের একজন কর্মী। এই তিনি হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী; যিনি পোড়া ক্ষতের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন। তিনি সবার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ২০২৩ সালে বিবিসির বিশ্বের সেরা ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ওঠে আসে জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীর নাম। তিনি একজন বার্ন সারভাইভার। ১৯৯৭ সালে রান্না করার সময় তার ওড়নায় আগুন লাগে। তখন শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এতে কুঁচকে বিকৃত হয় মুখ ও শরীরের কিছু অংশ। এ পর্যন্ত চামড়া প্রতিস্থাপনসহ তার শরীরে প্রায় ৫০ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এরপরও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, লিখেছেন বই। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠান জন্য কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।
খুলনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা জান্নাতুলের পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে। ২০১৩ সালে তার বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। জান্নাতুল ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০৫ সালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১০ সালে ব্র্যাক থেকে এলএলবি ডিগ্রি এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
শুধু তাই নয়; চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সও করেছেন জান্নাতুল। তিনি পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনটি। এ পর্যন্ত তার লেখা ১১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে যারা জীবনযাপন করেন, তাদের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিজের জীবনের গল্প বলে থাকেন তিনি। তিনি তার গল্প বলার সহজাত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে চারপাশের মানুষের মাঝে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ মানুষদের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করেন।
পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা নারীদের চলার পথ যে মসৃণ নয়, সেটা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই পদে পদে জেনেছেন আইভী। নিজের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ও তৃণমূল গবেষণায় জেনেছেন, শুধু প্রতিবন্ধী বলে কম দেওয়া হয় বেতন। আরও নানা বাধা থাকে তাদের জীবনে। এসব দূর করতেই আইভী ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক সংস্থা ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’। দগ্ধ প্রতিবন্ধীরা যাতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, তা নিয়ে কাজ করছেন তারা। কারণ, বর্তমান আইনে এ ধরনের মানুষদের কথা ভাবা হয়নি। তাই তারা বঞ্চনার মধ্যেই থেকে যান বলে মনে করেন ভয়েস অ্যান্ড ভিউজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী। দগ্ধ শরীরের কারণে বিভিন্ন সময় নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে।
নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিয়ে করেননি জান্নাতুল। এই সমাজে বিয়ে না করে একা থাকার এ সাহস জুগিয়েছেন তার মা। মা সবসময় বলে এসেছেন, শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন তাকে অনেক কটু কথা শোনালেও সবসময় তিনি পাশে পেয়েছেন তার পরিবারকে। তার মা তাকে বোঝা মনে না করে অন্যান্য সন্তানের মতোই আগলে রেখেছেন। যার ফলস্বরূপ, তিনি আজ সফল একজন নারী।
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী স্বপ্ন দেখেন, এ দেশে একদিন প্রতিবন্ধীরা গণপরিবহনে চলতে গিয়ে কটু কথা শুনবে না। ভবনের নকশা অনুমোদনেও প্রতিবন্ধী মানুষটির কথা মাথায় রাখা হবে। রাষ্ট্র যাতে এসব বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে- নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব নিয়ে সহায়তামূলক কাজও করবেন বলে তার ইচ্ছে রয়েছে।
জাহ্নবী