![মাহমুদা খাতুনের বইবাগান](uploads/2024/07/03/a-1719988411.jpg)
দেশি-বিদেশি দুর্লভ সব বই দিয়ে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল লাইব্রেরি। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করেছেন। অবসরে যাওয়ার পর নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে নগরীর শিরোইল এলাকার দেওয়ান মঞ্জিলে গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি। দেড় হাজার বর্গফুটের এই বিশাল লাইব্রেরিতে রয়েছে ৫ হাজারের অধিক বই। যেখানে ভ্রমণ, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাসসহ নানা ধাঁচের দুর্লভ সব বই ও ম্যাগাজিন দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রন্থাগারটি। যার গল্প বলছি, তার নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা।
মাহমুদা খাতুন ১৯৭৩ সালে রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করতেন। অল্প বয়স থেকেই বইপড়ার প্রতি ছিল তার ভীষণ রকম আগ্রহ। পাঠ্যবইয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি প্রবন্ধটি মাহমুদা খাতুনের মনের কোথায় যেন স্থান করে নিয়েছিল। তখন থেকেই বই নিয়ে কাজ করার এক তীব্র তাড়না অনুভব করেন তিনি। কিন্তু শিক্ষাজীবনের নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে সেই স্বপ্ন তখন আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠেনি। তবে ইচ্ছেটা ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
মাহমুদা খাতুন স্নাতক সম্পন্ন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন। তখন বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা আরও তীব্র হয়। বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকায় অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেননি। পড়াশোনা সম্পন্ন করে ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যোগ দেন তিনি। সেখানে দীর্ঘ চার দশক কাজ করেছেন। লাইব্রেরিতে কাজ করার সুবাদে বইয়ের সঙ্গে তার আত্মিক বন্ধন হয়েছে আরও সুদৃঢ়।
২০১৭ সালের ৩০ জুন ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদ থেকে অবসরে গ্রহণ করেন মাহমুদা খাতুন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বইয়ের প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরিতে ৪১ বছর কাজ করেছি। দিন দিন লাইব্রেরির প্রতি প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল, যদি কখনো সম্ভব হয় একটি পাবলিক লাইব্রেরি করব। সেই ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তারপর চাকরি থেকে অবসরের পর আমি যখন রিটায়ারমেন্টের টাকা পেলাম, তখন আমি সেই টাকার পুরোটা ব্যয় করে আমার বাড়ির চারতলায় একটি লাইব্রেরি করেছি। যেখানে আমাকে সহযোগিতা করেছে আমার দুই ছেলে, তানভীর অপু ও তারেক অণু।’
মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে তারেক অণু বলেন, ‘আমাদের এরকম একটি লাইব্রেরি করা দরকার, যেখানে অন্য মানুষ এসে বই পড়তে পারবে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারবে। লাইব্রেরি থেকে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে তরুণরা যে উন্নত জীবনবোধের চর্চা করবে সেখানেই আমাদের স্বার্থকতা।’
প্রান্তিক অঞ্চলে যেখানে লাইব্রেরি নেই, নন-একাডেমিক বই পড়ার সুযোগ নেই বললেই চলে, সেসব অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের বই পড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের জন্য কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে মাহমুদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরকম বড় পরিসরে লাইব্রেরি করতে না পারলেও প্রান্তিক অঞ্চলের বইপ্রেমীরা যেন নিজ উদ্যোগে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বইপড়ুয়াদের নন-একাডেমিক বই পড়ার সুযোগ করে দিতে পারে, এ ব্যাপারে আমি যথাসম্ভব উৎসাহ দিয়ে থাকি।’
লাইব্রেরি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? আপনার লাইব্রেরি কি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি লাইব্রেরির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করার পর তা সবার পড়ার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চাই। এখানে বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করবে। তবেই আমার সব প্রচেষ্টা স্বার্থক হবে।’
আপনার সংগ্রহে তরুণ লেখকদের বই আছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তরুণরা ভালো লিখছেন। আমার এখানে তাদের বই রয়েছে। সমসাময়িক বই থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প উপন্যাসসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্লভ সব বই সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে আমার ছেলেরা। এসব বই আমি লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রেখেছি।’
নতুন প্রজন্মকে বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বোধ তৈরি করতে হবে। একাডেমিক বই পড়ার পাশাপাশি তাদের নন-একাডেমিক বই পড়ায় উৎসাহ জোগাতে হবে। নন-একাডেমিক বই পড়ায় যে সময় নষ্ট হয় না, তা তাদের বোঝাতে হবে। জ্ঞানের বিভিন্ন সেক্টর সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে। ছেলেমেয়েরা জ্ঞানপিপাসু হলে বইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। তাদের জীবনবোধ উন্নত হবে।’
মাহমুদা খাতুন বলেন, ‘২০১৭ সালের আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই পড়ার ভিড় জমে যেত। শিক্ষার্থীদের জায়গা দেওয়া যেত না। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পুরো পাল্টে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে ঘরে বসেই কম্পিউটারে, মোবাইলে ই-বুক পড়ছে মানুষ।’
ই-বুক ও অডিও বুকের প্রভাবে হার্ডকপির বই কি অদূর ভবিষ্যতে খুব বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হবে? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ই-বুক ও অডিও বুকের মাধ্যমে বই পড়ার যে প্রকৃত তৃষ্ণা, তা পুরোপুরি মিটে বলে আমার মনে হয় না। সাজিয়ে রাখা তাক থেকে বই নামিয়ে তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে পড়ার যে আনন্দ তা ই-বুক পড়ে পাওয়া যায় না। ই-বুক, অডিও বুক জরুরি মুহূর্তে পড়া যায় বা শোনা যায়, তবে তা কখনোই হার্ডকপি বইয়ের চাহিদা মেটাতে পারবে না।’
অবসরের সব অর্থ দিয়ে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বইয়ের প্রতি যে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাহমুদা খাতুন, তা খুব প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ‘পৃথিবী বইয়ের হোক। ছেলেমেয়েরা ছোট থেকেই বই পড়ার মাধ্যমে ঘর থেকে জ্ঞান অর্জন করে বড় হোক। বই পড়ার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার আন্দোলন সবার মাঝেই ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।’
জাহ্নবী