![সুখীর সুখ কেড়ে নিল তিতাস গ্যাস](uploads/2024/03/31/1711862985.Narayanganj-Fire-Story-Fina.jpg)
‘ঘরের পাশেই ছিল তিতাসের পাইপলাইন। ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়ে চারপাশে গন্ধ ছড়াতে থাকলে জানানো হয় বাড়ির মালিককে। কিন্তু তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। সেখান থেকে ঘরে গ্যাস জমে হলো বিস্ফোরণ। মারা গেলেন সুখীসহ তার আরও দুই বোন। অথচ কিছুদিন আগেও তার সুখের সংসার ছিল।’ কথাগুলো ফরিদা নামে এক গৃহবধূর। তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যাওয়া সুখীর প্রতিবেশী। জ্বলন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে সুখী তার কাছেই নবজাতক কন্যাকে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। এরপর হাসপাতাল থেকে ফেরেন লাশ হয়ে।
সুখীর মতো নারায়ণগঞ্জের আরও বহু মানুষ জ্বলন্ত আগুনে পুড়েছে প্রাণঘাতী গ্যাস বিস্ফোরণে। গত চার বছরে তিতাস গ্যাসের পাইপ লিকেজ আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১৫ জন মানুষ। বেশির ভাগ ঘটনায় তিতাসের পুরোনো পাইপলাইনকে দায়ী করা হলেও এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং লিকেজ মেরামত আর গ্রাহকের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় সেরেছেন।
তবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এখনো আগ্নিঝুঁকিতে আছে বহুতল ভবন, মার্কেট ও মসজিদসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। তাই দুর্ঘটনা কমাতে হলে সমন্বয়ের পাশাপাশি সতর্কতা প্রয়োজন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, সব শেষ চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁয়ে গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে আব্দুর রশিদ এক ব্যক্তি মারা যান। তার আগে ৯ ফেব্রুয়ারি নগরীর কাশিপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ক্রোনি অ্যাপারেলস গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হন ১৪ জন। ৫ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জের একটি বাড়িতে গ্যাস বিস্ফোরণে এক দম্পতির মৃত্যু হয়। আর ২৬ জানুয়ারি সিদ্বিরগঞ্জে গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হন ছয়জন। তাদের মধ্যে সুখীসহ তিন নারী হাসপাতালে মারা যান।
২০২৩ সালে নারায়ণগঞ্জে ১২৮টি গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনার মধ্যে ১১৮টি ঘটে তিতাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান অন্তত ২৭ জন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৮২ জনকে। ২০২২ সালের ১০৪টি গ্যাস বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তার মধ্যে তিতাসের লাইনের ত্রুটি থেকে বিস্ফোরণ হয় ৬৯টি। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান ১৮ জন। ২০২১ সালে ১১৪টি গ্যাস বিস্ফোরণের দগ্ধ হয়ে মারা যান ২০ জন। ২০২০ সালে ১০৬টি গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ৪৪ জনের। এর মধ্যে তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণেই প্রাণ হারান ৩৪ জন। সব মিলিয়ে গত চার বছরে এ জেলায় গ্যাসের আগুনে নারী ও শিশুসহ অন্তত ১১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এ তো গেল মৃত্যু আর দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান। তবে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে বহুতল ভবন, মার্কেট ও মসজিদসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো। ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের উপসহকারী পরিচালক ফখরুউদ্দিন আহমেদ খবরের কাজগকে বলেন, ‘ঘটনার পর বিস্ফোরণের কারণ জানতে তদন্ত করে ফায়ার সার্ভিস। বেশির ভাগ ঘটনাতেই দেখা যায়, পাইপ লিজেক থেকে রুমে গ্যাস জমাট বেঁধে দুর্ঘটনা ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘রুমে গ্যাস জমাট বাঁধার পেছনের কারণ হলো, তিতাসের যে গ্যাস পাইপ রাইজার হয়ে বাসাবাড়ির দিকে সংযোগ যায়, সে সংযোগ পাইপের লিকেজ।’ ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাসাবাড়িতে দরজা-জানালা বন্ধ অবস্থায় যখন গ্যাস জমে থাকে তখন লাইট-ফ্যান চালু করতে গেলে বা ম্যাচ দিয়ে রান্নার কাজ করতে গেলে তা স্পার্ক করে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বসতিরা দগ্ধ হয়ে যান। তাই দুর্ঘটনা কমাতে সব দপ্তরের সমন্বয় প্রয়োজন। এরই মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ ও জননিরাপত্তা নেই এমন প্রতিষ্ঠান ও ভবনের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস।
সে তালিকার তথ্য বলছে, নারায়ণগঞ্জে ১৩৫টি বহুতল ভবন, ৪২টি মার্কেট, ১৬৩টি মসজিদ ও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৭৮টি হাসপাতাল-ক্লিনিকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে হতাহতের আশঙ্কা থেকেই যায়।
তিতাস গ্যাসের নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনার রশীদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ৮০ হাজারের বেশি আবাসিক গ্রাহকদের পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৪২২টি কলকারখানায় গ্যাস সঞ্চালন চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন দেখভাল করে ঢাকার আলাদা একটি বিভাগ। ফলে নতুন পাইপ স্থাপন তারাই দেখে। এখানে শুধু গ্রাহকরা পাইপের লিকেজের খবর দিলে তা মেরামত করে দেওয়া হয়। তিতাসের এই কর্মকর্তা দাবি করেন, বাসাবাড়িতে দুর্ঘটনার দায় গ্রাহকের। তিতাস শুধু দেখভাল করে বাইরের পাইপলাইন থেকে রাইজার পর্যন্ত। দুর্ঘটনা কমাতে হলে আগে স্থানীয়দের সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ বি সিদ্দিক বলেন, মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, তিতাস, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও নাগরিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি তদারকি দল গঠন করা প্রয়োজন। যেখানে নিয়ম মানবে না বা আইন ভঙ্গ করবে সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হলে গ্যাস বিস্ফোরণ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তবে গ্যাস বিস্ফোরণে এত মৃত্যু হলেও তা নিরূপণের কোনো উদ্যোগ নেই, এমনকি দুর্ঘটনার পর মামলা হয়েছে সে সংখ্যাও সীমিত। আর মামলা হলেও তদন্ত বেশি দূর গড়ায় না, তাই দোষীরা শাস্তি পেয়েছে এমন নজিরও কমই। নারায়ণগঞ্জের আদালত পুলিশের ওসি আসাদুজ্জামান খবরের কাজগকে বলেন, গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হলে সাধারণত ৩০৪ (ক) ধারা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের জেল। সঙ্গে অর্থদণ্ড করে থাকেন আদালত।
এদিকে দুর্ঘটনা রোধে তিতাস গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ডিপিডিসিকে আগে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমি হীরা বাইন।