![নির্বাচনে জিততে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ মোদি সরকারের!](uploads/2023/12/12/1702399600.Onion Pricekk.jpg)
ভারতে আগামী বছরের (২০২৪) শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের মন জয়ে ইতোমধ্যেই নানা উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এ কারণে চালের পর এবার পেঁয়াজের বাজারও স্থিতিশীল রাখতে চায় মোদি সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার গেজেট প্রকাশ করে কেন্দ্র। মূলত রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতেই পেঁয়াজ রপ্তানিতে লাগাম টেনেছে ভারত সরকার।
গত বৃহস্পতিবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে। এই খবরে বেসামাল হয়ে পড়ে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। ভারতীয় পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। এই ঘোষণার এক দিনের মধ্যেই ভারতের ৭০ টাকা কেজির পেঁয়াজ শুক্রবার দেশে ১৬০ টাকায় ওঠে। দেশি ১০০ টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। গত শনিবার তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। রবিবারও আগের দিনের মতো দাম আদায় করেন বেপারিরা। খুচরা পর্যায়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায় পেঁয়াজের দাম।
সম্প্রতি ভারতে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া এই নির্বাচন সামনে রেখে বেশ আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজেপি সরকার। ভোটারদের কোনোভাবেই চটাতে চাইছে না সরকারি দল বিজেপি। সে কারণে অক্টোবর মাসেই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই জানানো হয় আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না ভারত। সে সময় রপ্তানি বন্ধের এই ঘোষণা দেওয়ার আরও একটি কারণ ছিল, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলোতেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়। বাজারে পেঁয়াজের জোগান কমে যাওয়াতেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। অবস্থা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় সরকার পেঁয়াজের রপ্তানিতে নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
এদিকে চলতি বছরের নভেম্বরে চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। ভারতে রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বি ভি কৃষ্ণা রাও বলেছেন, মোদির সরকার দেশে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় এবং দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। তিনি বলেন, সরকার সম্ভবত আগামী বছরের নির্বাচন পর্যন্ত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি রাখবে।
এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের তুষ্ট করতে ভারত সরকারের কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে দেশের বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি একটি। এই প্রকল্পের আওতায় ভারতে ৮০ কোটির বেশি মানুষকে উপকৃত করতে চাইছে সরকার। গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হবে।
মূলত চাল ও পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করা, নিজের দেশে পণ্যগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণ এবং এর মাধ্যমে ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে জনগণকে তুষ্ট করতে মোদি সরকারের নানামুখী উদ্যোগেরই একটি অংশ।
বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজারের ভারতনির্ভরতা কতটুকু
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশি পেঁয়াজের দাম ১৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১০০ শতাংশ বেড়েছে। দেশি পেঁয়াজ এক বছর আগে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ এক বছর আগে ৪৫-৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ৯০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে আমদানি করা হলেও দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনে ঘাটতি নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে এ বছর পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ টন। কিন্তু মজুতের সুবিধা না থাকায় প্রায় ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আমদানি করতে হয় সাড়ে ছয় লাখ টনের মতো পেঁয়াজ। তার পরও পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। আমদানি করেও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি।
ভারতের পেঁয়াজের বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ
বাংলাদেশে সরকারি হিসাবেই চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়ে থাকে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল সোয়া ২৬ লাখ টন।
কিন্তু উৎপাদিত হয় ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টন পেঁয়াজ, যা চাহিদার চেয়েও ৭ লাখ ৬২ হাজার টন বেশি। তবে এর প্রায় ২২ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ সংগ্রহের পর নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ সরকার।
তবে পরিবহন খরচ ও পেঁয়াজের দাম বিবেচনায় আমদানিতে প্রতিবেশী ভারত সব সময়ই থাকে প্রথম পছন্দের তালিকায়।
ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০২২-২৩ সালে দেশটি সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে, যার পরিমাণ ৬ লাখ ৭১ হাজার টনের বেশি।
গত বৃহস্পতিবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে।
এ বিষয়ে ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির সরকার বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধে ভারতে কী প্রভাব পড়ল
এদিকে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের প্রভাব বাংলাদেশের পাশাপাশি দেশটির বাজারেও পড়েছে।
পেঁয়াজের সব থেকে বড় পাইকারি বাজার রয়েছে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। সেখানকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হীরামন পরদেশীর বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানায়, দুই দিন আগেও কৃষকরা এক কুইন্টাল (১০০ কেজি) পেঁয়াজের দাম পেয়েছেন ৪ হাজার রুপি করে। অথচ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরই দাম প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। শুক্রবার কৃষকরা এক কুইন্টাল পেঁয়াজের দাম পেয়েছেন দেড় থেকে ২ হাজার রুপি। কৃষকরা ওই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
খবরে বলা হয়, শনিবার মহারাষ্ট্রের বেশির ভাগ পেঁয়াজ বাজারে প্রতিবাদ হয়েছে বাজার বন্ধ রেখে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীরা রাস্তা অবরোধ করেছেন। তারা বলছেন, আগাম কোনো খবর ছাড়াই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এর ফলে কৃষক আর ব্যবসায়ী উভয়েরই বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
হীরামন পরদেশী বলেন, কৃষিপণ্যের বাজারগুলোতে ৯-১০ হাজার কুইন্টাল পেঁয়াজ আসে প্রতিদিন। খরিদ মৌসুমের পেঁয়াজ কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে।
এই বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ জমে থাকবে, অথচ হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় অসন্তুষ্ট সে দেশের ব্যবসায়ীরা।
[সূত্র: ব্লুমবার্গ, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, দ্য ওয়াল]