রেমিট্যান্সের ডলার কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি রেমিট্যান্সে এক মার্কিন ডলারের দর ৬ থেকে ৮ টাকা কমেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রাটির চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধিই এখানে ভূমিকা রেখেছে।
গত বৃহস্পতি (১৪ মার্চ) ও শুক্রবার (১৫ মার্চ) রেমিট্যান্সের এক ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৪ থেকে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। আগের সপ্তাহের ১২০ টাকার মতো দর ছিল।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২১৬ কোটি ডলার। রমজান শুরু হওয়ায় এবং সামনে ঈদুল ফিতর থাকায় মার্চ মাসে আরও ৫০ কোটি ডলার বেশি রেমিট্যান্স আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করতে এই প্রবণতা ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সে ডলারের দাম কমাকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেন ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, এই প্রবণতা বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতার লক্ষণ। তবে (মুদ্রাবাজারে) প্রকৃত স্থিতিশীলতা আসতে আরও ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগতে পারে বলে মত দেন তারা।
২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে দেশে মুদ্রার বিনিময় দর একটি স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যার সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে।
ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫-৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং রেমিট্যান্স প্রেরকদের মতো বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন সত্ত্বেও– ডলারের বিপরীতে টাকার পতন অব্যাহত থাকে।
২০২২ সালের জুন নাগাদ রেমিট্যান্সে ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা ১১৫ টাকা পর্যন্ত ছিল।
তবে আনুষ্ঠানিক হারের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করার পর যে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়— তাতে ওই বছরের অক্টোবরেই রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের দাম ১২২ টাকা বা তারও বেশি হয়ে যায়। ফলস্বরূপ; রেমিট্যান্সেও নামে ধস। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মন্তব্য করেন, ‘২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশের মুদ্রাবাজারের বিনিময় দরে নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ছিল যার অন্যতম কারণ। নির্বাচনের পরে বাজারে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, তখন সংশ্লিষ্টরাও কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।’
ব্যাংকারদের মতে, এখন সার্বিকভাবে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় অনেক ব্যাংকই আর চড়া দামে ডলার কিনছে না। দাম আরও বাড়বে এই আশায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ যারা ডলার সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, টাকার মূল্য বাড়তে থাকায় তারাও সেসব ডলার বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন।
দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে, বর্তমানে যা মাসে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। রপ্তানি আয়ও ঊর্ধ্বমুখী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে যা ৫০০ কোটি ডলারের বেশি হয়েছে। দেশের মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে আস্থা ফেরানোর সহায়ক হয়েছে এসব ঘটনা।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ২১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংকারদের মতে, ঈদ উপলক্ষে মার্চ শেষে তা ২৫০ কোটি ডলারের বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ঈদের আগে প্রবাসীরাও পরিবারের বিভিন্ন খরচের জন্য বাড়তি অর্থ পাঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ হাজার ৫০৮ কোটি ডলার (১৫ দশমিক শূন্য ৮) বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে যা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি প্রধান উৎস, রপ্তানি আয়েও রয়েছে ইতিবাচক ধারা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে যা ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি হয়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মুদ্রা অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করেছে। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডলারের সঙ্গে টাকার অদলবদল করতে পারছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার (ফরেক্স মার্কেট) স্থিতিশীল করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। কারেন্সি সোয়াপে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো তাদের কাছে থাকা ডলার দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে পারবে। এতে শক্তিশালী হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।