করোনা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে থাকে। মূল্যস্ফীতির কারণে লাগাম ছাড়া হয় ভোগ্যপণ্যের দাম। লাগামছাড়া হয় ভোগ্যপণ্যের বাজার। সেই থেকে বছরের পর বছর ভোগ্যপণ্যে বাড়তি দরের ঘানি টানছেন সাধারণ ভোক্তারা। আর ব্যবসায়ীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারসংকট, ডলার রেটে তারতম্য, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, কৃষকের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ কম, ভারত থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ এবং আমদানিকারকের বাড়তি দরে পণ্য বিক্রি করায় দাম বাড়ে- এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অজুহাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির করে রেখেছেন।
এদিকে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট কিছু অজুহাতের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে ভোগ্যপণ্যে অস্থিরতা। আমদানি মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি হয়েছে। সম্প্রতি ১ হাজার ৬০০ টাকার এলাচ ৩ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি করার প্রমাণ মিলেছে খাতুনগঞ্জে। পেঁয়াজে ভালো ফলন হয়েছে। তবুও ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না, সরবরাহ কম- এমন অজুহাতে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আবার পেঁয়াজ আমদানির খবরে খাতুনগঞ্জে দাম কমে যাওয়ার চিত্রও দেখা গেছে। তখন আমদানি খরচ বাড়ার অজুহাত কোথায় যায়? তখন কী লোকসান হয় না? ভরা মৌসুমেও কেন চালের দাম বাড়তি থাকে। আলু, গম, চিনি, ডিমের দাম কেন বাড়তি? মুরগি, সবজি তো আমদানি হয় না। কেন বছরের পর বছর এসব পণ্যের দামে অস্থিরতা থাকে- সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই ২০২২ সালে খাতুনগঞ্জে মণপ্রতি সয়াবিন তেলে ৪০০ টাকা বেড়ে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পাশাপাশি মণপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে পামতেল ৬ হাজার ও সুপার পামতেল ৬ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে গম মণপ্রতি ৫০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ১৫০ টাকায়, চিনি মণপ্রতি ৪০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৬৮০ টাকায় বিক্রি হয়। বস্তাপ্রতি চাল আগের তুলনায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বাড়তি দরেই বিক্রি হয়। খাতুনগঞ্জে দেশি মসুর ডাল ১১২ টাকা, পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৪৮ টাকা, আদা ১৭০ টাকা, প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায়।
২০২৩ সালে ডলারসংকট, আমদানি খরচ বাড়ার অজুহাতে খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ চিনিতে ৮০০ টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকা এবং খোলা চিনি ১০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা মানেননি। উল্টো সে সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই বছর সরকার বোতলজাত তেলে লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়ায়। তখন বোতলজাত প্রতি লিটার তেল ১৯৯ টাকায় বিক্রি হয়।
চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এর প্রভাব ছিল না বাজারে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৩ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকার বেশি দামে। বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৮০ টাকা, প্রতি কেজি ভারতীয় চোরাই চিনি ১০৫ টাকা ও পরিশোধিত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৮ টাকায়। চায়না আদা ২৪৫ টাকা, রসুন ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সব ধরনের চালে বস্তাপ্রতি দাম বাড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫, ভারতীয় পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।
খুচরায় প্রতি কেজি চিনি মিলছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকায়। খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায়। খুচরায় মোটা দানার মসুর ১১০ টাকা, চিকন মসুর ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি ডজন ডিম ১৬০ টাকায়, সব ধরনের সবজি ৫০ থেকে ৮০ টাকায় ও ব্রয়লার মুরগি মিলছে ১৭৫ টাকায়।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজার তো ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করে বাড়িয়ে রাখেন না। আমরাও চাই বাজারদর নিয়ন্ত্রণে থাকুক, স্বাভাবিক থাকুক। বাজার দর ওঠা-নামা করলে আমাদের ব্যবসায় সমস্যা হয়। কিন্তু অনেক সময় আমদানি খরচ বাড়লে বাড়তি দরে পণ্য বিক্রি করেন, কৃষকরা দাম বাড়িয়ে দেন, পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। এসব কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে।’
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিএসএম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দর কমতির দিকে। যেমন: বর্তমানে গমের দাম নিম্নমুখী। তার ওপর ডলার রেটের প্রভাবটা এখন তেমন একটা দেখছি না। তার ওপর পণ্যের বেচাবিক্রিও তেমন নেই। কাজেই এখন পণ্যের দাম বাড়তি থাকার কথা না।’
ভোক্তারা বলছেন, করোনার আগেও পণ্যের দাম বাড়ত। কিন্তু তখন একটা সুনির্দিষ্ট পণ্যে সিন্ডিকেট বা দাম বাড়ানো হতো। কিন্তু করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে সুযোগে ডলারসংকট ও ডলার রেটের তারতম্যকে পুঁজি করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যে দাম বাড়ানোর অনুশীলন তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন তারা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত বাজার তদারকি করছি। অভিযোগের ভিত্তিতেও অভিযান পরিচালনা করছি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কারচুপি আছে। আমরা অভিযানে গেলে কাগজপত্র ঠিকমতো পাই না। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’