নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ও অরুয়াইল ইউনিয়নের মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে নৌযান তৈরি শিল্পকারখানা। ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব কারখানায় শুষ্ক মৌসুমে নৌযান তৈরি করা হয়। এখানে তৈরি নৌযান যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শুরু হয় নৌযান তৈরি করার কাজ।
গত ৭ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অরুয়াইল গ্রামের শিল্প উদ্যোক্তা আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ ভাঙার ভারী ইস্পাত শিট এনে ভারী নৌযান তৈরির কাজে লাগিয়ে থাকি।’
এক সময় নৌযান তৈরির মিস্ত্রি বর্তমানে শিল্প উদ্যোক্তা হাসান আলী বলেন, ‘এক সময় আমি অন্যের অধীনে কাজ করতাম। ১৪ বছর কাজ করেছি। পরবর্তী সময়ে নিজেই নৌযান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করি। এখন আমি নিজেই একটা কারখানা দিয়েছি। নৌকা বানানোর জন্য চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ভারী ইস্পাত নিয়ে আসি। একটি নৌকা তৈরি করতে ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মতো খরচ হয়।’
অপর উদ্যোক্তা সাইফুর রহমান মানিক জানান, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে এসব যান। বর্তমানে উৎপাদন খরচ বাড়ায় একটি নৌযান বানাতে ১ কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ হয়। আগে এসব নৌকা বানাতে খরচ পড়ত ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা।
অপর এক উদ্যোক্তা শামীম হোসেন বলেন, ‘আমরা এখানে দেশীয় প্রযুক্তিতে নৌযান তৈরি করি। আমাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে না। নদী তীরের জায়গা কাজে লাগিয়ে সরকার ইচ্ছে করলে এটিকে চট্টগ্রামের মতো নৌযান তৈরি শিল্পকারখানার এলাকা করতে পারে।’
নৌযান শিল্পের সঙ্গে জড়িত মাইনউদ্দিন হাসান বলেন, ‘আমাদের এলাকায় নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো। আমাদের এই অরুয়াইলে যদি সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বিবেচনায় অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে গুরুত্ব পায় তাহলে নতুন শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।’
একই পেশায় জড়িত শফিক আহমেদ বলেন, ‘সরাইলের অরুয়াইল অনেক বছর ধরে ঐতিহ্যগতভাবে অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত। পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের পরিচালিত করা হচ্ছে না। যদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে দেশের অন্যতম শিল্প এলাকা হবে আমাদের আরুয়াইল।’
নৌযান তৈরি কাজে নিয়োজিত স্থানীয় প্রকৌশলী হাবিব মিয়া জানান, প্রতিটি নৌযান তৈরি করতে অন্তত ৬ মাস সময় লাগে। নৌযান তৈরির কাজ শেষ হলে ইঞ্জিন এবং প্রোপেলার লাগানোর পর রং করা হয়। নৌপথে পণ্য পরিবহনে খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় দিন দিন বড় নৌকার চাহিদা বাড়ছে। ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে এই শিল্পের প্রসার হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি লাভবান হচ্ছেন এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি সুব্রত পাল বলেন, ‘মেঘনা ও তিতাসের তীরে অনেক জায়গা আছে যেখানে শিল্পকারখানা স্থাপন অথবা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) করা যাবে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাব অরুয়াইলের এই প্রাচীন ব্যবসা কেন্দ্রের জায়গাটিকে বিশেষ শিল্প এলাকা গড়ে তুলতে। বিশেষ শিল্পাঞ্চল স্থাপিত হলে আগামীতে চাকরির চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাবে। এতে দেশের বেকারত্ব কমবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ সরাইল আশুগঞ্জের সংসদ সদস্য মাইনউদ্দির মঈন বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে নৌকাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সরাইল উপজেলার অরুয়াইল গ্রামের নদীর পাড়ের জমির দাম বেশি হওয়ায় এখানে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প এলাকা গড়ে তুলতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তবে আমাদের পরিকল্পনাতে পাশের এলাকা রানীদিয়া গ্রাম আছে সেখানে নৌযান তৈরি করার জন্য বিশেষ অঞ্চল করার পরিকল্পনা আছে। অরুয়াইলের এই অঞ্চলকে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে গুরত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে কাজ করা হবে।’
এই বিষয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবা উল আলম ভূঁইয়া জানান, অরুয়াইল এলাকাটি সরাইলের মধ্যে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এ ছাড়া এই শিল্পকে বিকশিত করতে এর সঙ্গে জড়িতদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই এলাকাকে ইকোনোমিক হাব করার জন্য ইতোমধ্যেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইউনিয়ন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম খাদেম বলেন, ‘অরুয়াইলে গড়ে ওঠা নৌযান শিল্প কারখানার উদ্যোক্তারা যদি সঠিক কাগজপত্র দিতে পারেন তাহলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করব।’
এখানে তৈরি করা এক একটি নৌযানের ৫০০ থেকে ১ হাজার টন পণ্য ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিটি নৌযান সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে পণ্য পরিবহন করে নদীপথে ঢাকা-বরিশাল মাওয়া-কাওড়াকান্দিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে থাকে।
অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ভৌগোলিক অবস্থান সহজ হওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভাবে দিনদিন শিল্পকারখানার উদ্যোক্তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এই জেলায়। তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, নৌ ও স্থলবন্দর এবং বড় ধানের মোকামের কারণে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।