![দামি পানির গোপন রহস্য](uploads/2024/05/25/BGTY-1716622014.jpg)
মানুষ কিংবা অন্য কোনো প্রাণী পানি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তাই পানির অপর নাম জীবন। সব ধরনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য। পৃথিবীতে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ অংশ জুড়ে পানির অস্তিত্ব রয়েছে। দেশে এক লিটার পানি কিনতে খরচ হয় ২৫ থেকে ৪০ টাকা। শুনলে অবাক হবেন বিশ্বের এমন পানিও আছে, যার এক বোতলের দাম লাখ লাখ টাকা!
প্রকৃতির দান পানির কেন এত দাম হবে, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। এমন কী আছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের এই মিশেলে, যার জন্য আকাশছোঁয়া দাম? এই বিলাসী পানি কখনো হয়তো সংগ্রহ করা হয়েছে হাওয়াই দ্বীপের ভলকানিক পাথর থেকে, কোনো ক্ষেত্রে তা সংগৃহীত নরওয়ের কোনো গলিত হিমবাহ থেকে বা তাসমানিয়ায় ঘাসে জমা শিশিরবিন্দু থেকে। এ ধরনের পানিকে বলা হয় ‘পিয়োরেস্ট অব পিয়োর’। তবে এসব দামি পানির বিশেষ গুণও রয়েছে। তাই তার এত কদর। প্রকৃতির দান পানির কেন এত দাম হবে, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। জেনে নিন বিশ্বের সবচেয়ে দামি পানির রহস্য ও উপকারিতা কী কী রয়েছে-
স্প্রিং ওয়াটার
স্প্রিং ওয়াটার। এ পানির নাম যেমন সুন্দর তেমনি এর দামও আকাশছোঁয়া। এই পানি সংগ্রহ করা হয় নদী বা ঝরনার উৎসমুখ থেকে অর্থাৎ তা হিমবাহের বরফগলা পানি, যাতে সেরা মিনারেলস পাওয়া যায় এবং তা বিশুদ্ধ। স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহের বেশ কিছু নিয়ম আছে। সেই জায়গায় ওই অবস্থায় তা সংগ্রহ করতে হবে এবং বোতলবন্দিও সেখানেই করা হবে। তাই যথাযথভাবে নিয়ম মেনে স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না এবং তা প্রকৃতই স্প্রিং ওয়াটার কি না সেটা বলা সম্ভব নয়, যদি না তা খুবই বিখ্যাত কোনো সংস্থার হয়, যারা সব সময় নিজেদের মান সম্পর্কে সচেতন। পুষ্টিবিদদের মতে, এই পানি অবশ্যই শরীরের জন্য খুব ভালো।
অ্যাকোয়া দ্য ক্রিন্তালো ট্রিবুতো আ মোদিগিলানি
বিশ্বের সবচেয়ে দামি পানি মনে করা হয় ‘অ্যাকোয়া দ্য ক্রিন্তালো ট্রিবুতো আ মোদিগিলানি’কে। কারণ, এতে লুকিয়ে রয়েছে হাজারো রহস্য। এই পানিতে নাকি মেশানো রয়েছে ৫ গ্রাম ২৪ ক্যারেটের খাঁটি সোনা। এতে পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এর পানি সংগ্রহ করা হয় পৃথিবীর তিনটি স্থান যেমন- ফ্রান্সের একটি ঝরনা, ফিজি দ্বীপের একটি প্রস্রবণ এবং আইসল্যান্ডের হিমবাহ থেকে। শুধু পানি নয়, ৭৫০ মিলিলিটার পানির বোতলেও রয়েছে চমক।
কারণ, এ পানির বোতল তৈরি করা হয়েছে ২৪ ক্যারেটের সোনা দিয়ে। বোতলটির নকশা করেছেন ফার্নান্দো আলতামিরানো নামে একজন জনপ্রিয় শিল্পী। এক দশক আগে এ পানির বোতলের দাম ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬০ লাখ। এখন এর দাম আরও বেড়েছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের সাধ্যের অনেকটা বাইরে এই পানি। এই জলের দামের আর এক কারণ অবশ্য তার বোতলের ডিজাইন এবং প্যাকেজিং। প্ল্যাটিনামে মোড়া সীমিত সংস্করণের অসাধারণ দেখতে এই বোতলে ছয় হাজার হীরা খচিত। পানিতে মিশ্রিত রয়েছে ২৩ ক্যারেটের পাঁচ গ্রাম সোনার ভস্ম। অতএব বোঝাই যাচ্ছে দামের কারণ।
নিগারি
মানুষের ওজন কমাতে, শক্তি জোগাতে এবং ত্বকের গুণমান সমুন্নত রাখতে সাহায্য করে নিগারি পানি। এ পানি সম্পর্কে এমনটাই বলা হয়ে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের এক হাজার ফুট নিচে হাওয়াই দ্বীপ থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয়। এ পানি অন্যান্য ব্যয়বহুল বোতলজাত পানির চেয়ে বেশি তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম, এ পানি আরও বেশি তৃপ্তিদায়ক বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক প্রখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ফিটনেস প্রশিক্ষক এ পানি পান করতে সুপারিশ করে থাকেন। ৭৫০ মিলিলিটারের এক বোতল পানি ৪০২ ডলারে বিক্রি হয়।
ফিলিকো
পানিও যে সুস্বাদু হয় তা ফিলিকো পানি পান করলেই বোঝা যায়। দাবা খেলার গুটির সঙ্গে পরিচয় থাকলে খুব সহজেই ফিলিকোর বিশেষভাবে ডিজাইন করা বোতলগুলো চেনা যাবে। নকশায় রাজকীয় ভাব রাখতে এর বোতলের নকশা করা হয়েছে দাবার রাজা এবং রানির গুটির মতো করে। স্বরভস্কি ক্রিস্টালের কাচের বোতল দেখতে বেশ মার্জিত এবং এর পানিও খুব সুস্বাদু। এ পানি সংগ্রহ করা হয় জাপানের কোবের নুনোবিকি নামে পরিচিত অতি বিশুদ্ধ ঝরনা থেকে। এ পানির ৭৫০ মিলিমিটারের বোতলের দাম রাখা হয়েছে ২১৯ ডলার।
ব্লিং এইচ২০
আরেকটি দামি পানির নাম ব্লিং এইচ২০। এ পানি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। ব্লিং ওয়াটার যেখান থেকে আসে ঠিক সেখানেই বোতলজাত করা হয়। টেনেসির গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার গোড়ায় অবস্থিত ইংলিশ মাউন্টেন ঝরনা থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয়। এ পানির স্বাদ অক্ষুণ্ন রাখতে ৯টি পর্যায়ে পরিশোধন করা হয়। এ পানি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ, স্পাগুলোয় পরিবেশন করা হয়। ব্লিংয়ের বোতল খোলার অভিজ্ঞতা অনেকটা দামি শ্যাম্পেইনের বোতল খোলার মতো। এর প্রতিটি ৭৫০ মিলিলিটার বোতলের দাম রাখা হয়েছে ৪০ ডলার।
ভিন
ভিনের পানি এসেছে ফিনল্যান্ড থেকে। একে বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং সতেজ পানির অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে ঝরনা থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয় সেটি ফিনিশ ল্যাপল্যান্ডের কাছে অবস্থিত। ফিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক আর্কটিক অঞ্চল বলে পরিচিত কোনিসাজো ঝরনায় পৌঁছানোর আগে এ পানি প্রাকৃতিকভাবে বেশ শীতল পরিবেশের মধ্য দিয়ে ফিল্টার করা হয়। এরপর এ পানি সংগ্রহ করা হয়। তৃষ্ণা মেটাতে এর অস্বাভাবিক গুণসহ আরও বেশকিছু কারণে এ পানিকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ৭৫০ মিলিলিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ ডলার।
অ্যাকোয়া ডেকো
অ্যাকোয়া ডেকো অন্যতম ব্যয়বহুল পানি। ডেকো শব্দের অর্থ শৈল্পিক। পানির বোতল হিসেবে এ বোতলের শৈল্পিক সৌন্দর্য সেটাই প্রমাণ করে। মানুষের হাতের ছোঁয়া কানাডার একটি বিশুদ্ধ ঝরনা থেকে এ পানি দৃষ্টিনন্দন চমৎকার এ বোতলে সংগ্রহ করা হয়।
২০০৭ সালে এ পানি সেরা নন-কার্বনেটেড পানীয়র স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক জয় করেছিল। বিলাসী পানি পায়ীদের কাছে এ পানির বিশেষ কদর রয়েছে। বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, হোটেল এবং স্পাতে বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ৭৫০ মিলিলিটারের বোতলজাত এ পানির দাম রাখা হয়েছে ১২ মার্কিন ডলার।
ডিস্টিলড ওয়াটার
ডিস্টিলড ওয়াটার পানি ফুটিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। তারপর সেই বাষ্পকে ফের পানিতে পরিবর্তিত করা হয়। ফলে এর মধ্যে কোনো মিনারেলস থাকে না। এই পানি খেলে কোনো রকম পেটের সমস্যা হবে না। কিন্তু ক্রমাগত যদি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজবিহীন ডিস্টিলড ওয়াটার খাওয়া হয়, তা শরীরের জন্য উপযোগী নয়।
অ্যালক্যালাইন ওয়াটার
অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ইদানীং খুবই জনপ্রিয় হয়েছে সেলেব্রিটিদের সুবাদে। সাধারণ পানির পিএইচ লেভেলের চেয়ে অ্যালক্যালাইন ওয়াটারের পিএইচ লেভেল বেশি থাকে। তাই মনে করা হয় যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা খুব বেশি তারা অ্যালক্যালাইন ওয়াটার খেলে ভালো থাকবেন। রিসার্চ বলছে না যে দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকালাইন ওয়াটার খাওয়া শরীরের জন্য ভালো। এতে কিছুটা হলেও মিনারেলস থাকে, তবে তা যে শরীরের জন্য ১০০ শতাংশ ভালো, তা বলা যায় না। আবার অনেকে ভাবেন অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ক্যানসারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় এবং তা বয়স ধরে রাখে—এর কোনোটিই কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রমাণিত নয়। অ্যালক্যালাইন ওয়াটারে মিনারেলস ইনফিউজ করা হলে তাকে ব্ল্যাক ওয়াটার বলা হয়। এই পানিও খুব দামি।
সব ধরনের পানি সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। পানি যেন পরিস্রুত হয় এবং তাতে মিনারেলস যেন যথাযথ থাকে, খাওয়ার আগে এটুকু দেখে নিলেই যথেষ্ট। এতে পেটের গোলমাল বা অন্য রোগের ভয় থাকে না।
পানি বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে পুরোনো ও কার্যকর পদ্ধতির একটি হলো সেটা ফুটিয়ে নেওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্দেশনা হলো, পানিতে বলক এসে ফুটতে শুরু হওয়ার পর মাত্র ১ মিনিট জ্বালালেই পানিতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া নিষ্ক্রিয় হয়। পানি ফোটানোর মাধ্যমেই ক্ষতিকর জীবাণু দূর করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকতে ফিল্টারের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করা যেতে পারে।
কলি