প্রবাল এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণী। প্রবালকে বলা হয় সমুদ্রের স্থপতি। বহিরাবরণ শক্ত হওয়ার কারণে অনেক সময় একে ভুল করে পাথর ভাবা হয়। পলিপ নামের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর সমন্বয়ে তৈরি হয় একেকটি প্রবাল।
সাধারণত গভীর সমুদ্র যেখানে আলো প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে, সেখানে রংবেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির প্রবালের দেখা মেলে। এদের দেহ নিঃসৃত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3) জমাট বেঁধে কঠিন বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে।
প্রবাল সমুদ্রের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। প্রবালের বিশাল কাঠামোয় প্রায় ২৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রজাতি বাস করে। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে শুরু করে কেনিয়া ও মেক্সিকোর উপকূলরেখা পর্যন্ত প্রবাল প্রাচীরের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার মানে এগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত তিন দশকের মধ্যে চতুর্থবারের মতো এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের শীর্ষ প্রবাল প্রাচীর পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইউএস ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) কোরাল রিফ ওয়াচের সমন্বয়কারী ডেরেক মানজেলো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারই ফলে বিশ্বের অন্তত ৫৪টি দেশ ও ভূখণ্ডে প্রবালের রং পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।’
মানজেলো আরও বলেন, ‘প্রবাল মূলত অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এদের বাইরের আবরণে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণে শক্ত ও প্রতিরক্ষামূলক কাঠামো রয়েছে। বাইরের এই শক্ত আবরণ রঙিন এককোষী শৈবালের বাসস্থান হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার অসামঞ্জস্যের ফলে এই রঙিন শৈবালগুলো প্রবালের গায়ে থাকতে পারছে না। অন্যদিকে এই শৈবাল ছাড়া প্রবালও টিকে থাকতে পারে না। কারণ প্রবালের পুষ্টির জোগান দেয় এই রঙিন শৈবালগুলো।’ অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোর ৫৪ শতাংশের বেশি প্রবাল প্রাচীর ক্ষয়ে যাচ্ছে বলে জানান মানজেলো।
এল-নিনো সাধারণত সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। গত বছর সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ১৯৭৯ সালের রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে এল-নিনোর প্রভাবকেও দায়ী করা হচ্ছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশমন্ত্রী তানিয়া প্লিবারসেক বলেন, ‘আমরা জানি বিশ্বব্যাপী প্রবাল প্রাচীরের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জলবায়ুর পরিবর্তন। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফও হুমকির মুখে রয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্টে উপকূলীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হওয়ায় ক্যারিবিয়ান প্রবাল প্রাচীরগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।’
মেক্সিকো ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির সামুদ্রিক পরিবেশবিদ লরেঞ্জো আলভারেজ-ফিলিপ বলেন, ‘দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের প্রাচীরগুলো ক্ষয় হতে শুরু করে। বিশ্বের অনেক প্রবাল প্রাচীর এই তীব্র তাপের চাপ থেকে পুনরুদ্ধার করা যাবে না বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন। সেই সঙ্গে আমরা এখনই বলতে পারছি না যে এই অত্যধিক গরমের চাপ কীভাবে প্রবাল প্রাচীরগুলো মোকাবিলা করবে। এটি বিজ্ঞানের জন্যও নতুন একটি ঘটনা।’
প্রাক-শিল্প যুগে বিজ্ঞানীরা যে বৈজ্ঞানিক মডেলগুলো দিয়েছিলেন, সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি আর ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তাহলে সারা বিশ্বে থাকা প্রবালগুলোর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলের ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা জানান, আর ১ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেই প্রবাল প্রাচীরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাস্তুসংস্থান বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কেনিয়ার মোম্বাসার উপকূলীয় মহাসাগর গবেষণা ও উন্নয়ন এবং ভারতীয় মহাসাগরের পূর্ব আফ্রিকার প্রধান পরিবেশবিদ ডেভিড ওবুরা বলেন, ‘একটি বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা হলো, আমরা প্রবাল প্রাচীরের জন্য হুমকিস্বরূপ সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছি। যদি জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনের প্রধান কারণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বন্ধ না করি, তাহলে প্রবাল প্রাচীরের হারিয়ে যাওয়া আমরা আটকাতে পারব না।’প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হলে মাছের মতো প্রাণীর আবাসও ধ্বংস হবে। প্রবাল প্রাচীর হারিয়ে গেলে পৃথিবীর ঝুঁকি আরও বাড়বে।
সূত্র: রয়টার্স
কলি