![বইমানুষ](uploads/2024/06/15/btrew-1718434725.jpg)
টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পাঠাগার গড়লেন জামাল হোসেন। বর্তমানে পাঠাগারে বই আছে ১০ হাজার। সেই পাঠাগারের নামে জামালের বাবা আব্দুল সাত্তার আলী লিখে দিয়েছেন ৫ শতাংশ জমি। জামাল নিজ জেলা লালমনিরহাটে করেছেন ৫০টি সেলুন পাঠাগার। তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় সারা দেশে গড়ে উঠেছে আরও ১ হাজার ২৩৪টি সেলুন পাঠাগার।
একজন জামাল হোসেন
ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে স্নাতকের ছাত্র জামাল। বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর সারপুকুরের টিপার বাজারে।
যেভাবে শুরু
একবার একটি বইয়ের প্রয়োজন পড়ল জামাল হোসেনের। অনেক খুঁজলেন, পেলেন না। এক স্যারকে ধরলেন। স্যার জানালেন, উপজেলায় পাবলিক লাইব্রেরি নেই। পরে জামাল পণ করলেন, নিজেই পাঠাগার করবেন। সে জন্য মাটির ব্যাংকে টিফিন ও নানা উপলক্ষে পাওয়া টাকা জমালেন।
২০১৪ সালে লালমনিরহাটের সারপুকুরে পাঠাগার করলেন। নাম দেন ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’। কয়েকটি বই, মাটির ব্যাংকে জমানো সামান্য টাকা আর এক বুক সাহস নিয়েই তার পথচলা শুরু।
ভাঙা ঘরেই আলোর মশাল
বই রাখা এবং মানুষকে বই পড়ানোর জন্য ঘরের দরকার পড়ল জামালদের। তার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল আরডিআরএসের একটি ভাঙা চালার পরিত্যক্ত ঘর। একটি বেড়াও ছিল না। জামাল আরডিআরএসের লোকদের ধরলেন। তার কাকুতিমিনতিতে কর্তৃপক্ষ সদয় হলো। জামালরা টিন ও বাঁশ সংগ্রহে নেমে পড়েন। কালেকশনের ফাঁকে উঠানে মাদুর বিছিয়ে বন্ধুরা মিলে বই পড়তেন। কবিতা আবৃত্তি করতেন।
একদিন বিআরডিবির পল্লী উন্নয়ন উপজেলা কর্মকর্তা নুরেলা আক্তার জামালদের বাসা পরিদর্শনে এলেন। উঠানে মাদুর বিছিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে তিনি জামাল ও তার বন্ধুদের ডাকলেন। পাঠাগার করার কথা শুনে খুশি হয়ে জামালের হাতে ১ হাজার ৫৬০ টাকা তুলে দেন। দু-একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও দু-এক শ টাকা দিয়েছিলেন। একদিন পাঠাগার দাঁড়িয়ে গেল। মানুষ আসতে শুরু করল।
১০ হাজার বইয়ের পাঠাগার
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জামাল তার স্বপ্নের পাঠাগার ধীরে ধীরে গড়ে তুলেন। জামাল বইয়ের জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি গেলেন। স্যারদের কাছে হাত পাতলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বড় ভাইদের বই দিতে বললেন। কোথাও রচনা প্রতিযোগিতা হলেই অংশ নিতেন। বিজয়ী হলে বই মেলে। বন্ধুদেরও প্রতিযোগিতায় টানতেন।
ভাষাসৈনিক শামসুল হক শুরুতে দিলেন ৩৫টি বই। এভাবে সে বছর বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ৩ হাজার। পরে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র প্রতি বছর বই পাঠাল। কাজী ফার্ম দিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বই। জামালের পাঠাগারে এখন বই আছে ১০ হাজারের মতো।
![](../../../image/2024/June-24/btyu.jpg)
সেলুন লাইব্রেরি
এই বই পড়ার আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন সেলুন লাইব্রেরি তৈরির পরিকল্পনা। ২০১৭ সালে গ্রামের নরসুন্দরের সঙ্গে দোকানে বই রাখার ব্যাপারে আলাপ করলেন। টিপার বাজারের এক সেলুনে বই রাখলেন। কিছুদিন পর বিভিন্ন সেলুন থেকে চাহিদা আসতে লাগল। জামাল খুশি মনে দিলেন। খবর নিয়ে দেখলেন, লোকজন বই পড়ছে। পরে টিপার বাজার ছাড়িয়ে জেলার অনেক দোকানে বই দিলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারা দেশে এর মধ্যে ১০০টি সেলুন লাইব্রেরি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জামাল বললেন, ‘নিজ জেলায় ৫০টি সেলুন লাইব্রেরি করেছি। এখন সারা দেশে আমার পরামর্শ ও নেতৃত্বে ১ হাজার ২৩৪টি সেলুন লাইব্রেরি আছে।’
বাবা দিলেন জমি
জামাল হোসেন বাবার কাছ থেকে ৫ শতাংশ জমি পাঠাগারের নামে লিখে নিয়েছেন। বাবা শুরুতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানলেন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় তিনতলার ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে পাঠাগারের কাজ বর্তমানে বন্ধ হয়েছে। জামাল আশা করেন, সমাজের বিত্তবানরা এই বই পড়া আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তার সঙ্গে শামিল হবেন।
ঝুলিতে আছে দেশসেরা পুরস্কার
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এর মধ্যে বেশ পুরস্কার পেয়েছেন জামাল হোসেন। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ভলান্টিয়ার পুরস্কার। সামাজিক কাজে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বে চারজনকে ভিএসও গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড দেন প্রতি বছর।
বাংলাদেশে জামালই প্রথম এ পুরস্কার পেলেন। এ ছাড়া তিনি সেরাদের সেরা ইয়েস ফ্রেন্ডস অ্যাওয়ার্ড, কবি অসীম সাহা সম্মাননা, কবি জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র নজরুল সাহিত্য পুরস্কার, ইয়ুথ চ্যাম্পিয়ন ব্র্যাক, রংপুর বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক পুরস্কার, জাতীয় ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। জামাল বললেন, ‘দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবেসে আগামী দিনে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই দাঁড়াতে পারে না।’
কলি