এখন বা এক মুহূর্ত পর কী হতে যাচ্ছে, তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন। এইতো মনে পড়ে, কিছুদিন আগে শ্রেয়াকে যখন প্রেগনেন্সি রিপোর্টটা দেখিয়ে বললাম ‘তুমি মা হতে চলেছ’, খুশিতে ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমি কোনো দিন কাউকে এত খুশি হতে দেখিনি।
কিছুদিন পর শ্রেয়াকে নিয়ে শ্রীপুরে জয়ন্তী দেবীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিই। বাসা থেকে বেশ দূরে। আমি নিজেই ড্রাইভিং করছিলাম। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। চার দেয়ালে ঘেরা অনেক পুরোনো বাড়ি। আশপাশে গাছগাছালি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল না। একজন বৃদ্ধ চাচা আমাদের আশ্রয় দেন। বাড়িটিতে তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। খুব সম্ভবত তিনি বাড়ির কেয়ারটেকার। বললাম, ‘চাচা, আমরা বিপদে পড়েছি। ঝড় কমলেই চলে যাব। কিছুটা সময় এখানে থাকতে দিন।’ তিনি বললেন, ‘আজ রাতটা অনেক খারাপ। ভয় নেই, রাতটা এখানে থাকেন। সকালে চলে যাবেন।’
এই কথা বলে তিনি আমাদের জন্য খাবার আনতে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘আজ রাতটা সুবিধার না, ভুলেও কেউ বাইরে যাবেন না। এই যে দেখেন, কিছুক্ষণ আগে ঝড় ছিল, এখন নেই। একটু পর আবার শুরু হবে।’ শ্রেয়া বলল, ‘চাচা, আজ রাতটা খারাপ বলছেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘মা, আপনারা এ যুগের মানুষ, বিশ্বাস করবেন না। এই গ্রামে জয়ন্তী দেবী মন্দির নামে একটি মন্দির আছে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে মন্দিরের দেবী প্রতি বছর একজন করে কুমারী মেয়ে নিয়ে যেত। এখন বছরের এই রাতে একজন করে কুমারী মেয়ে বের হয়, যে মানুষের ক্ষতি করে।’ শ্রেয়া বলল, ‘আপনি কি এখন পর্যন্ত কোনো মেয়েকে মন্দির থেকে বের হতে দেখেছেন?’
’না, আমি দেখেনি। তবে অনেকেই দেখেছে।’
অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। দরজার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে ডাকছে, ‘কেউ আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলুন। আমি অনেক বিপদে পড়েছি।’ আমি দরজাটা খুলতে গেলে চাচা আমার সামনে দাঁড়ান। আমাকে বাধা দিয়ে বলেন, ‘বাবা, আপনার পায়ে ধরি, দরজাটা খুলবেন না। খুললে আমরা সবাই বিপদে পড়ব।’
‘কী বলেন! একটা মানুষ বিপদে পড়ে ডাকছে। আর আমরা দরজা খুলব না?’
চাচাকে ধাক্কা দিয়ে আমি দরজাটা খুলে দিই। আধ ভেজা হয়ে ১৭-১৮ বছরের মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকেই বলল- ‘দয়া করে আজ রাতটা আমাকে থাকতে দিন। আমি ট্রেনে যাচ্ছিলাম। পাশের রেলস্টেশনে ট্রেনটা থামল। আমি কিছু খাবার কেনার জন্য নামলাম। আর তখনই ট্রেনটা আমাকে রেখে চলে গেল। এর মধ্যে ঝড় শুরু হলো। অনেকটা সময় ছোটাছুটি করার পর এ বাড়িটি দেখতে পাই। প্লিজ, রাতটা আমাকে এখানে থাকতে দিন। সকালে ভোরের ট্রেনে চলে যাব।’
থাকার জন্য চাচা মেয়েটিকে একটি রুম দেখিয়ে দিলেন।
ঝড় আবার থেমে গেল। আমি আর শ্রেয়া শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ খেয়াল করি, শ্রেয়া ভীষণ কাঁপছে। ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘শ্রেয়া, তোমার কি খারাপ লাগছে?’
‘আমার অনেক ভয় হচ্ছে। দেবীটা তোমাকে মেরে ফেলবে। চল আমরা চলে যাই।’
আমি হেসে বললাম, ‘কী সব উলটাপালটা বলছ? দেবী আবার আসল কোথা থেকে?’
‘দেখোনি, দেবীর মতো মেয়েটি কেমন করে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটি মানুষ না, মানুষরূপী দেবী। ও আমাদের পিছে পিছে ওই জয়ন্তী দেবী মন্দির থেকে এসেছে।’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ও ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটাকে আর দেখা গেল না। দরজা খোলা ছিল। খুব সম্ভবত ভোরের ট্রেনে মেয়েটি চলে গেছে।
ওই রাতের পর থেকে শ্রেয়া অস্বাভাবিক সব আচরণ করতে শুরু করে। শ্রেয়ার অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। শুধু ভাবতাম, আর কয়েকটা দিন। মা হলেই ও ভালো হয়ে যাবে। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানসহ আমি আমার পুরোনো শ্রেয়াকে ফিরে পাব। প্রার্থনাই শেষ সম্বল।
আমি আবার ছুটে চলি জয়ন্তী দেবী মন্দিরে। যাওয়ার পথে ওই চার দেয়াল ঘেরা পুরোনো বাড়িটি দেখে কেয়ারটেকার চাচাকে খুঁজতে যাই। যা জানতে পারি, তার সারমর্ম হচ্ছে ‘সেদিনের ওই ঝড়ের রাতের পর একটি মেয়ের লাশ পাওয়া যায় বাড়িটির পুকুরপাড়ে। তার জন্য কেয়ারটেকারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি বলে হাজতবাস করছেন।’
তারপর নিম্ন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে, অনেক কষ্টে নিজেকে অপরাধী এবং চাচাকে মুক্ত করি। কারণ, সেই রাতে আমার জীবননাশের আশঙ্কার কথা ভেবে মেয়েটাকে শ্রেয়াই পুকুরে ফেলে দিয়েছিল, পরে জানতে পেরেছিলাম। আজ আমার হাজতবাসের তৃতীয় দিন। খুব অস্থির অনুভব করছিলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে শ্রেয়ার দুই বাক্যের একটি চিঠি আসে।
‘আমি এবং তোমার মেয়ে দুজনই ভালো আছি। আর আমি তোমার মেয়ের নাম রেখেছি জয়ন্তী।’
-তোমার শ্রেয়া
ইঙ্গোলস্ট্যাড, জার্মানি
কলি