‘একাত্তরের ২৮ নভেম্বর রাতে খুলনার বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করি। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পটিতে হামলা চালানো হয়। পশ্চিম দিক থেকে চুপিসারে ক্যাম্প ভবনের গায়ে বোমা লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাই আমরা। এতে ৮-৯ জন রাজাকার মারা গেলেও বাকিরা পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করে। হঠাৎ সহযোদ্ধা আজিজের বুকে গুলি লাগে। তাকে নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। মৃত্যুর আগে আজিজ বলেছিল, ওকে যেন তার মায়ের পাশে কবর দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সহযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্যোতিষ মারা গেলে ৬-৭ ঘণ্টা একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাই। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল শত্রুর গুলিতে বুঝি এখনই আমার মৃত্যু হবে। বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাহস ছিল।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ থেমে চোখ মুছলেন খুলনার বটিয়াঘাটার বারোআড়িয়া যুদ্ধের অধিনায়ক বিনয় সরকার। প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধের চোখেমুখে তখন রণাঙ্গনের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। সেদিনের যুদ্ধে তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বারোআড়িয়া ছাড়াও তিনি নগরীর বয়রা মোড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে অবরোধ যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে পাইকগাছা, কপিলমুনি ও গল্লামারী যুদ্ধে অংশ নেন।
একটুখানি দম নিয়ে বললেন, ‘আমার তো সেদিনই মারা যাওয়ার কথা ছিল। জ্যোতিষ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর একাই শত্রুর ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছি। তারপর দুপুর ২-৩টার দিকে আমাদের সহযোদ্ধারা চারপাশ থেকে এগিয়ে আসার পর শয়তান রাজাকাররা পালাতে শুরু করে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিনয় সরকার একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে খুলনায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তার সহাসিকতা ও যুদ্ধ-কাহিনি নিয়ে একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে বারোআড়িয়া যুদ্ধ নিয়ে ‘যাদের দানে মুক্ত বাংলা’, ‘শহীদ জ্যোতিষ আজিজ বীর বিনয়’ অন্যতম।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিনয় সরকার বলেন, ‘বারোআড়িয়া যুদ্ধের আগে আমরা একটা লঞ্চ অপারেশন করি। যাতে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে রাজাকারদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রাতে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আমরা লঞ্চটাকে ডুবায়ে দিই। পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। খবর আসে বারোআড়িয়ায় রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন করছে। বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর পরামর্শে বারোআড়িয়ায় রাজাকারদের ক্যাম্প দখলের প্রস্তুতি নিই। এ যুদ্ধের জন্য আমাকে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। ২৮ নভেম্বর রাতে কনকনে শীতের মধ্য দিয়ে নৌকায় করে পুঁটিমারী ক্যাম্প থেকে ১৭ জনের দলটি বারোআড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের কাছে আরসিএল, এলএমজি, এসএমজি, কয়েকটি এসএলআর ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। গভীর রাতে বারোআড়িয়া বাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তার ওপর এসে আমরা অবস্থান নিই। মনি গোলদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে রাজাকাররা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। বজলুর রহমান রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য লাগিয়ে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু আশানুরূপ ফল হয়নি। রাজাকাররা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। যুদ্ধে জ্যোতিষচন্দ্র মণ্ডল ও মোল্লা আব্দুল আজিজ শহিদ হলে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে পরদিন দুপুর ২টা-৩টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধা ছিল নুরুল আলম খোকন, সামছুর রহমান, হরিপদ, মুকুল বিশ্বাস, জ্যোতিষ, তপন, আজিজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে রেকি করা হয়েছিল ওই ক্যাম্পে ৮-১০ জন রাজাকার থাকে। কিন্তু সেদিন সেখানে রাজাকার ছিল ২৫-৩০ জনের মতো। শুরুতেই বোমার বিস্ফোরণে ৮-৯ জন মারা যায়। পরে গুলিতে আরও ৭ জন মারা যায়। এর মধ্যে বারোআড়িয়া বাজারে দোকানের মধ্যে একটি লোক গুলিবিদ্ধ হয়। সে যন্ত্রণায় চিৎকার ছটফট করছিল। তাকে বের করে আনতে গিয়ে আজিজের বুকে গুলি লাগে। কয়েকজনকে দিয়ে তাকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তাকে নৌকা জোগাড় করে দিতে দেরি হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের সাড়া না পেয়ে অন্য পাশে থাকা সহযোদ্ধারা পিছু হটে যায়। উত্তর পাশে রয়ে যাই আমি আর জ্যোতিষ। দুর্দান্ত সাহসী জ্যোতিষ ছিল ডিউটি কমান্ডার।
অন্যরা কোথায় আছে খোঁজ নিতে গেলে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্যোতিষ ওই স্থানে মারা যায়। ওই সময় আমি পুরোপুরি একা হয়ে পড়ি। তখন সবেমাত্র সকাল হয়েছে। ওই সময় থেকে দুপুর ২-৩টা পর্যন্ত একাই লড়েছি। এর মধ্যে রাজাকারদের আরও চারজন মারা যায়। আমি ভেবেছিলাম, যতক্ষণ বেঁচে থাকব গুলি চালাব। এদিকে আমাদের ক্যাম্পের অন্যরা যখন দেখল আমি আর জ্যোতিষ ফিরছি না, তখন বুঝল আমরা ঘটনাস্থলেই রয়ে গেছি। তখন দুপুরের দিকে চারপাশ থেকে ক্যাম্প আক্রমণ করলে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এখানেই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল।
এই ক্যাম্প থেকে লঞ্চযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি অংশ বটিয়াঘাটা চক্রাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান মুক্ত হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহর জয়ের উদ্দেশ্যে চক্রাখালী ক্যাম্পে জড়ো হয়। চক্রাখালী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গল্লামারীর রেডিও সেন্টারের (বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে) সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করে। খুলনায় আমরা চারদিক থেকেই শহরে ঢোকার চেষ্টা করছিলাম। ১৪ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত গল্লামারীতে যুদ্ধ হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও গল্লামারীর পাকসেনারা ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। এরপর বিজয়ের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা হেঁটে সার্কিট হাউস ময়দানে এসে হাজির হয়।’
স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বিনয় সরকার ভারতের আসামে তিন মাস প্রশিক্ষণ নেন। সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। তার প্রশিক্ষিত দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।