ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলী ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকার ওয়ারী জোনের গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান গ্রেপ্তার দুজনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহর আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, তারা সীতাকুণ্ডের একটি মন্দিরে লুকিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সোর্স ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি এও জানিয়েছেন যে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড পলাতক আক্তারুজ্জামান শাহীনের পাশাপাশি আরও একজন জড়িত আছেন, যাকে তারা কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে দেখেছেন। তবে ওই ব্যক্তির বিষয়ে তারা বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি। তারা দাবি করেছেন, ওই ব্যক্তিকে ভারতে আটক হওয়া কিলার সিয়াম চেনেন। ওই ব্যক্তি কে তা শনাক্তে কাজ করছেন মামলার তদন্তকারীরা।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল দুজনই আনার হত্যায় গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ। তাদের দুজনকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিমুলের ভূমিকা ছিল। মোস্তাফিজুর ট্রাকচালক ও ফয়সাল শ্রমিক ছিলেন। তারা খুলনায় একটি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা স্বীকার করেছেন যে টাকার লোভে পড়ে তারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছিলেন। আনার হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করার জন্য শিমুলের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেই টাকা পাননি। দেশে এসে শিমুলের কাছে তারা খুনের মিশন বাস্তবায়নের টাকা চাইতে গেলে উল্টো শিমুল তাদের হুমকি-ধমকি দেন। এতে তারা চুপসে যান। পরে শিমুল পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর দুজনই গা-ঢাকা দেন।
মামলার তদন্তকারীরা জানান, আনারকে হত্যার পর লাশ টুকরা করার ক্ষেত্রে মোস্তাফিজুর, ফয়সাল, জিহাদ ও সিয়ামের ভূমিকা ছিল। জিহাদ ও সিয়ামকে কলকাতার পুলিশ আগেই গ্রেপ্তার করেছে। মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলার তদন্তের গতি বাড়বে। সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদে কলকাতার পুলিশ যে তথ্য পেয়েছে, তা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের জানিয়েছে। মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই তথ্যগুলো মেলানোর চেষ্টা করা হবে। তবে মামলার তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আনার হত্যার মূল মোটিভ জানা যায়নি। তবে দ্রুতই তা জানা যাবে এবং তারা তদন্তের শেষ পর্যায়ে এসেছেন।
এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া মুস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলীকে পুলিশ আদালতে হাজির করলে আদালত তাদের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন এমপি আনার। ২২ মে আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ এ মামলায় গ্রেপ্তার করে শিলাস্তি রহমান, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজিকে। পরে আদালত শিলাস্তিসহ মোট তিনজনকে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
প্রথম দফায় রিমান্ডে কিছু তথ্যের ঘাটতি থাকার কারণে ডিবি পুলিশ গত ৩১ মে পুনরায় আদালতে আসামিদের হাজির করে আবার রিমান্ডের আবেদন করে। শিমুল ভূঁইয়া তার জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক গ্যাস বাবুর কথা বলেন। গ্যাস বাবু আবার ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর এ খুনে জড়িত হওয়ার কথা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান।
পরে গত ১১ জুন ধানমন্ডি এলাকা থেকে মিন্টুকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর মিন্টুকে ১৩ জুন ডিবি পুলিশ আনার হত্যাকাণ্ডের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তাকে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আনার হত্যা মামলার তদন্তের মুখ্য সমন্বয়কারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ খবরের কাগজকে জানান, ‘মামলার তদন্ত চলছে। আমরা মূল মোটিভ উদঘাটনের জন্য কাজ করছি।’
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, কলকাতার ফ্ল্যাটে যারা উপস্থিত থেকে হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল তাদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল ছিলেন। এদের গ্রেপ্তার করার পর মামলার তদন্তে নতুন করে গতি আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিছু নতুন তথ্যের খোঁজ পাওয়া গেছে। তারা দাবি করেছেন, মাস্টারমাইন্ড শাহীনের সঙ্গে তারা ত্রিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে তারা কলকাতার ফ্ল্যাটে দেখেছেন। ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে মাঠে কাজ করছেন মামলার তদন্তকারীরা। দরকার হলে মামলার আসামিদের পুনরায় রিমান্ডে আনা হবে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, এখন পর্যন্ত এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী সাতজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃত মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল গত ১৯ মে ঢাকায় আসেন। ২২ মে আনার হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে তারা সীতাকুণ্ডে চলে যান। সেখানে নাম পরিবর্তন করে পলাশ রায় ও শিমুল রায় পরিচয়ে রাতে পাতালকালী মন্দিরে অবস্থান করেন। এভাবে তারা ওই মন্দিরে ২৩ দিন কাটিয়ে দেন। পরে সীতাকুণ্ডের একটি পাহাড়ের নিচে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরও জানান, কলকাতার একটি মার্কেট থেকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে আনেন তারা। সঙ্গে আনেন ক্লোরোফর্ম। সেই চেয়ারে বেঁধে আনারকে বিবস্ত্র করা হয়। এই কাজগুলো করেছেন ফয়সাল। আর হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সিয়াম এনে দিয়েছিলেন ফয়সালকে। ফয়সাল আলী তাকে পেছন থেকে গলা ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল দিয়ে চেপে ধরেন। এরপর অন্য আসামিদের সহযোগিতায় তাকে অজ্ঞান করে হত্যা করেন। কেন এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা সুনির্দিষ্ট মোটিভ বলতে পারছি না।’