![জেলা আ.লীগ সম্পাদক মিন্টু আটক](uploads/2024/06/11/Anar_Mintu-1718109437.jpg)
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ডিবির একটি দল ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে আটক করে।
আনার হত্যার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু আটক হওয়ার পর এ খুনের সঙ্গে জেলার ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জড়িত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করে। এরপরই গোয়েন্দারা জেলার নেতাদের নজরদারিতে রাখা শুরু করেন। খুনের মোটিভ জানতে সংগ্রহ করে সবার বায়োডাটা। এ হত্যাকাণ্ডের মাঠপর্যায়ে তদন্তের শুরুতে ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর সম্পৃক্ততার নাম আসে।
তখন মাঠপর্যায়ে আরও তদন্ত করে ডিবি পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বিষয়টি হাই কমান্ডকে অবহিত করে। তাকে আটকের বিষয়ে গ্রিন সিগনাল পাওয়ার পর গতকাল তাকে আটক করা হয়। গ্রেপ্তার গ্যাস বাবু পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিন্টুর নাম বলেছিলেন।
এ ছাড়াও রিমান্ডে এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি তানভীর ভুঁইয়া ডিবি পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে মিন্টুর সখ্য ছিল। গোটা জেলার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুজন মিন্টুর লোক বলে পরিচিত ছিলেন। এ কারণে তাদের সবাই সমীহ করতেন। আর জেলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এমপি আনার। ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের পরবর্তী কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে পারেন বলে একটি গুঞ্জন ছিল। প্রার্থী হতে তিনি জেলার অধিকাংশ কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলাদা-আলাদা যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন আলাদা বলয়। বিষয়টি টের পেয়ে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মাঠ থেকে আনারকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন মিন্টু- এমন তথ্য গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
তারা আরও জানতে পেরেছেন, এ খুনের পরিকল্পনা গত ২ মাস আগে থেকেই জানতেন মিন্টু। মিশন সফল করতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অর্থও দিয়েছিলেন। আনার নিখোঁজ হওয়ার আগে শাহীনকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে কলকতায় গিয়েছিল। পরে শাহীন ওই টাকা রিসিভ করেছিলেন।
এদিকে, হত্যাকাণ্ডের পরই ডিবির একটি দল কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানকার পুলিশ ও সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বৈঠক করেছেন।
নৃশংস এই খুনের অন্যতম হোতা সিয়াম এখন ভারতের সিআইডির হেফাজতে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি বাংলাদেশের ডিবি পুলিশকে কিছু তথ্য দিয়েছেন। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই কারা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ৬ জন নায়িকা ও মডেলকে শিগগিরই জিজ্ঞাসাবাদ
কলকাতার পুলিশের কাছে দেশের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের ৬ জন নায়িকা ও মডেলকে কলকাতার পঞ্চলা ও গৌরবতীর ফ্ল্যাটে শাহীন নিয়ে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে আনার এক চিত্রনায়িকার সঙ্গে সময়ও কাটিয়েছিলেন। ওই নায়িকা কলকাতার একাধিক ছবিতে অভিনয় করে সুনামও কুড়িয়েছেন। বয়স ৩০ এর কোটায় বাংলাদেশি ওই নায়িকা চলনে-বলনে স্মার্ট বলে পরিচিত। আনার হত্যার ঘটনায় এই ছয় মডেল ও নায়িকাকে খুব শিগগরি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্র জানিয়েছে।
গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। ২২ মে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ এ মামলায় গ্রেপ্তার করেন শিলাস্তি, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজিকে। পরে আদালত শিলাস্তিসহ মোট তিনজনকে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম দফায় রিমান্ডে কিছু তথ্যের ঘাটতি থাকার কারণে ডিবি পুলিশ গত ৩১ মে পুনরায় আদালতে আসামিদের হাজির করে আবার রিমান্ডের আবেদন করে।
শিমুল ভূঁইয়া তার জবানবন্দিতে গ্যাস বাবুর কথা বলেন। গ্যাস বাবু আবার ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর এ খুনের জড়িত হওয়ার কথা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আনার হত্যাকাণ্ডে যারাই জড়িত হোক না কেন সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা তদন্ত অব্যাহত রেখেছি।’
আনার হত্যাকাণ্ড মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকাণ্ডে আগে যে কয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের কাছে মিন্টুর নাম জানা যায়নি। তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। তবে মাঠপর্যায়ে ডিবি তদন্ত অব্যাহত রাখেন। আনার হত্যাকাণ্ডের পর মিন্টুর গতিবিধি ভালো ছিল না। প্রযুক্তির মাধ্যমে তাকে ডিবি ট্র্যাকিং করা শুরু করলে তিনি ঢাকা, ঝিনাইদহ, খুলনায় অবস্থান করা শুরু করেন। এ মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের নেতা গ্যাস বাবু গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার নাম উঠে এলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সূত্র জানায়, মিন্টুর রাজনৈতিক অতীত কর্মকাণ্ড ভালো ছিল না। তার নামে ৪টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও ঝিনাইদহের বাসস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড, মাছের আড়ত, অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং লালনের অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র জানায়, ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপুর আলাদা একটি বলয় ছিল। সেই বলয়ে এমপি আনার ছিলেন। এ কারণে মিন্টু আনারকে তার জেলার রাজনীতিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছিলেন। জেলার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দুই গ্রুপের মধ্যে সংর্ঘষের ঘটনা ঘটেছিল। এতে মিন্টু আনারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। ডিবি জানিয়েছে, এ মামলায় মিন্টুকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হবে।
এদিকে, গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হাইওয়ে পুলিশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা আমরা কখনোই বলিনি। আমরা সব সময় বলে আসছি এমপির ওই এলাকা সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। ওখানে আসলে কী হয়েছে সেটা আমাদের জানতে হবে। আমরা তদন্ত করছি, তদন্তের পরে আপনাদের সব কিছু জানাব।
এমপি আনারের মেয়ে ডরিন সন্দেহভাজনদের নাম বলেছেন। কাদের নাম বলেছেন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন তদন্ত চলে তখন আমাদের মন্ত্রী, আইজিপি কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা সম্ভব না। আমরা মনে করি তদন্ত শেষ হলে এগুলো নিয়ে কথা বলব।
এ ছাড়াও গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, এমপি আনারের হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা কার কার কাছে বিষয়টি শেয়ার করেছেন সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
তিনি আরও বলেন, সকল তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে মনে করেছি ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এ জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনেছি। তার রিমান্ড চলছে, তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ঘটনা ডিবি ওয়ারী বিভাগ তদন্ত করছে।
হারুন আরও বলেন, বাংলাদেশে ও ভারতে গ্রেপ্তার আসামিদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূল ঘাতক আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়াসহ অন্যরাও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডটি ভারতে সংঘটিত হয়েছে এবং সব আসামি বাংলাদেশি। হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় সব আসামি বাংলাদেশে চলে আসেন।
হত্যাকাণ্ডের পর দুই কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে হারুন বলেন, এগুলো আমরাও শুনেছি, সবকিছু তদন্ত করছি। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন বাংলাদেশ থেকে দিল্লির পর কাঠমান্ডু, এরপর দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তাকে আমরা ধরতে না পারলেও মোটামুটি বাকি সব আসামিদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। আসামিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছি, ভারতে জিহাদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া কাঠমান্ডু থেকে গ্রেপ্তার সিয়ামকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজন মনে করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাব।
শিলাস্তির জামিন নামঞ্জুর
এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশে অপহরণের মামলায় শিলাস্তি রহমানের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলাম গতকাল তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। জামিন আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন আদালত। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা (আদালতে দায়িত্বরত) উপ-পরিদর্শক জালাল উদ্দিন এ তথ্য জানিয়েছেন।
এই মামলায় এর আগে গত সোমবার আরও দুই আসামি শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্যাহ সাঈদ এবং তানভীর ভূঁইয়ার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন আদালত।
গত ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করা হয়। এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন এই মামলা করেন।
কলকাতা থেকে আমাদের প্রতিনিধি দীপঙ্কর দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, গত মাসে কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিবা গার্ডেনের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংস খণ্ড এবং ভাঙড়ের বাগজোলা খাল থেকে উদ্ধার হওয়া হাড়গোড় একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের। ফরেনসিক বিভাগের প্রাথমিক এই পর্যবেক্ষণ হাতে পাওয়ার পর এবার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি।
সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানিয়েছেন, ওই মাংস এবং হাড়ের টুকরো বাংলাদেশের এমপি আনারের কি না তা নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতি নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
সিআইডি সূত্রের খবর, ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি পাওয়া গেলে এমপি আনারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকা কোনো আত্মীয়কে ডেকে পাঠানোর জন্য ফের আদালতে আবেদন জানাবে সিআইডি। উল্লেখ্য আনারকন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন এই পরীক্ষায় ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। আদালতের অনুমতি পেলেই তাকে কলকাতায় ডেকে পাঠানো হবে। ডরিনকে কলকাতায় নিয়ে আসার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে।