![পেটানোয় পটু আনার এমপি](uploads/2023/11/17/1700196833.MP-Anar.jpg)
গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায় তার নাম ছিল। মাদক চোরাচালান, অর্থ পাচার, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতির বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও পেটানোয় বিশেষ পটু তিনি। এমন বহুবিধ অপকর্মে পারদর্শী মানুষটি হলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজিম আনার।
ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ খবরের কাগজকে জানান, যাকে-তাকে পেটানোয় বিশেষ পটু সংসদ সদস্য আনার। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের একাধিক নেতাকে খুনের অভিযোগ রয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার অনেক অভিযোগও আনারের বিরুদ্ধে। কালীগঞ্জের কলেজে ঢুকে এক শিক্ষককে পিটিয়ে সারা দেশে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী জানান, ঝিনাইদহ এলাকায় মাদক চোরাচালান ও অর্থ পাচারের মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান আনার। অন্তত দুই ডজন মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি ২০০৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কালীগঞ্জে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে মামলার সংখ্যা কমিয়ে আনতে থাকেন। পরে নির্বাচিত হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এরপর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হওয়ার পর পুরো কালীগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।
দলের নেতা-কর্মী খুন, নির্যাতনের অভিযোগ
দলের একাধিক নেতা-কর্মী খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এমপি আনারের বিরুদ্ধে। তবে তিনি বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। গত বছরের নভেম্বরে যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলামকে কালীগঞ্জ শহরে নিজের বাসার নিচে কুপিয়ে হত্যা করে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। আরিফুল কালীগঞ্জের সাবেক এমপি মান্নানের অনুসারী ছিলেন। এ ঘটনায় এখনো আনার ও তার সহযোগীদের হুমকি-ধমকির মধ্যে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন আরিফুলের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।
আরিফুলের স্ত্রী রেশমা লস্কর খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমপি আনার খুনিদের প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছেন। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, যদি আবার মনোনয়ন পান, তাহলে আমাকে মারতে মারতে মামলা তুলতে (প্রত্যাহার) নিয়ে যাবেন। আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দুপুরে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে পৌরসভা অডিটোরিয়ামে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা চলছিল। সে সভায় হামলা চালায় আনারের সমর্থকরা। তারা ১১ জনকে কুপিয়ে আহত করে। হামলায় মারা যান কোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনন্দমোহন ঘোষ। সেই ঘটনার মামলায় পরিবারের পক্ষ থেকে আনার ও সহযোগীদের আসামি করার আবেদন করা হলেও প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকে নিজেকে বাঁচান আনার। পরে তার সহযোগীদেরও মামলা থেকে বের করে আনেন।
আনন্দমোহন ঘোষের স্ত্রী রিংকু ঘোষ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার পাইনি। এলাকার মানুষদের মধ্যেও এ নিয়ে ক্ষোভ আছে। ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।’
আশির দশক থেকে ১৭-১৮ বছর নিয়ামতপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন আবু সাঈদ বিশ্বাস। তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। খবরের কাগজের কাছে নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে আবু সাঈদ বিশ্বাস বলেন, ‘২০১৭ সালে স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশে আমাকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসায় আনার। আমাকে তুলে নিয়ে আট দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে নির্যাতন চালায়। সে নির্যাতনে স্ট্রোক হয়ে আমার শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গেছে। গত অক্টোবরে সেই মামলার রায়ের পর আমাকে জেলে যেতে হয়। গত সোমবার আমি জেল থেকে জামিনে বের হয়েছি।’
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আনোয়ারুল আজিম আনারকে কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন খান। আয়ুব নব্বইয়ের দশকে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন ও দলের দুর্দিনে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেছেন। বর্তমানে তিনিও আনারের জুলুমের শিকার।
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন খান গত বুধবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমিসহ কালীগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়নের নেতা-কর্মী নির্যাতিত। আমার ইজারা নেওয়া বাঁওড় জোর করে দখল করে নিয়েছে সে। আমাকে মিথ্যা চেক জালিয়াতির মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। কালীগঞ্জের সবাই এ বিষয়ে জানে।’
আয়ুব হোসেন খান বলেন, ‘কালীগঞ্জের সংখ্যালঘুরা আনারের দ্বারা নির্যাতিত। তারা আতঙ্কে আছে। সবাই মনে করছে, সে যদি আবার এমপি হয় তাহলে সবাইকে এলাকাছাড়া হতে হবে।’
২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদ ইকবাল শিপন মৃধাকে এক বৈঠকে আনোয়ারুল আজিম নিজেই মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে আজাদ ইকবাল শিপন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই শেখের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুর রহমান একসময়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আনারের হাতে পুরোনো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রায় সবাই নির্যাতিত। তার ভাগ্নে বারবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ আমাকেও মারধর করেছে।’
নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কবির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার চাচা প্রায় ২৩ বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর জানাজা আটকে দিয়েছিলেন আনার। তিনি দাবি করেছিলেন আমার চাচার কাছে টাকা পান। অথচ চাচা জীবিত অবস্থায় কোনোদিন শুনিনি আনার টাকা পাবেন।’
বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক
২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর গঠিত ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ছিলেন পিকুল হোসেন। তাকে গত বছর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার প্রভাব খাটিয়ে পিকুলকে সাধারণ সম্পাদক করেন।
আনোয়ারুল আজিম আনারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেন কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শিবলী নোমানী। এই নোমানীর বাবা মোমিন মৌলভি তালিকাভুক্ত রাজাকার। এ বছর যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর মৃত্যুর পর ফেসবুকে শোক জানিয়েছিলেন শিবলী নোমানী।
কোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন বাদশা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, দলের লোকেরা কেউ আনারের সঙ্গে নেই। যারা জীবনে কখনো জয় বাংলা বলেনি তাদের নিয়ে চলেন আনার।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আনারের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করছেন আব্দুর রউফ। এই রউফ বিএনপির এমপি শহীদুজ্জামান বেল্টুর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগেও গোলাম রসুল পরিচিত ছিলেন জামায়াতের ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে। এখন তিনি সংসদ সদস্য আনারের ঘনিষ্ঠজন। আনারের ছত্রচ্ছায়ায় কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ সরকারি সুগার মিলে সিন্ডিকেট গড়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গোলাম রসুল।
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন খান বলেন, ‘পৌর জামায়াতের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন গোলাম রসুল। তাকে সুগার মিলের নেতৃত্বে এনে কোটিপতি বানিয়েছেন আনার।’
শিক্ষক পিটিয়ে আলোচনায়
গত বছরের মে মাসে এক কলেজশিক্ষককে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন আনোয়ারুল আজিম আনার। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজে ঢুকে এক শিক্ষককে মারধর এবং আরেক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেন আনার ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় সেদিনেই কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান ঝিনাইদহের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এমপি আনার গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনকে চড়থাপ্পড় মারেন। এতে ওই শিক্ষকের কান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কবির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যে শিক্ষককে পিটিয়েছেন তার বাড়ি আমাদের ইউনিয়নে। এ ঘটনায় ইউনিয়নের লোকেরা ক্ষুব্ধ। আনার যদি আবারও মনোনয়ন পায় তাহলে আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের লোকেরাও তাকে ভোট দেবে না।’
ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, ২০০৭ সালে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। সে সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গা-ঢাকা দেন আনোয়ারুল আজিম আনার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৫টি মামলা ছিল। এসব মামলায় তিনি ফেরারি আসামি ছিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান ও অর্থ পাচার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে তার নাম ছিল ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায়। সে সময়ে একাধিক গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।
অভিযোগের জবাবে যা বললেন আনার
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের কিছু লোক বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়ে দলের জন্য বদনাম এনেছে। তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি। সে কারণে তারা এখন আমার বিরুদ্ধে নানা বানোয়াট অভিযোগ দিচ্ছে। যেগুলোর কোনো সত্যতা নেই।’
ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘তখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়। আমার নামে রাজনৈতিক কারণে অনেক মামলা ছিল। পরে সেগুলো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করেছি।’
রাজাকার-সন্তান শিবলী নোমানীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘শিবলীর বাবার কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু শিবলী ছাত্রলীগ করেছে, এখন যুবলীগের দায়িত্বে আছে।’
দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-নির্যাতনের প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিইনি। কেউ অপরাধ করে থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় তার সাজা হবে, সেটা স্বাভাবিক।’ কলেজশিক্ষককে পেটানোর অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন আনার।
সালমান/