ঢাকা ২১ আষাঢ় ১৪৩১, শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪

পেটানোয় পটু আনার এমপি

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১১:২০ এএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৯ এএম
পেটানোয় পটু আনার এমপি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায় তার নাম ছিল। মাদক চোরাচালান, অর্থ পাচার, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতির বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও পেটানোয় বিশেষ পটু তিনি। এমন বহুবিধ অপকর্মে পারদর্শী মানুষটি হলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজিম আনার।

ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ খবরের কাগজকে জানান, যাকে-তাকে পেটানোয় বিশেষ পটু সংসদ সদস্য আনার। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের একাধিক নেতাকে খুনের অভিযোগ রয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার অনেক অভিযোগও আনারের বিরুদ্ধে। কালীগঞ্জের কলেজে ঢুকে এক শিক্ষককে পিটিয়ে সারা দেশে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী জানান, ঝিনাইদহ এলাকায় মাদক চোরাচালান ও অর্থ পাচারের মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান আনার। অন্তত দুই ডজন মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি ২০০৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কালীগঞ্জে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে মামলার সংখ্যা কমিয়ে আনতে থাকেন। পরে নির্বাচিত হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এরপর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হওয়ার পর পুরো কালীগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। 

দলের নেতা-কর্মী খুন, নির্যাতনের অভিযোগ

দলের একাধিক নেতা-কর্মী খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এমপি আনারের বিরুদ্ধে। তবে তিনি বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। গত বছরের নভেম্বরে যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলামকে কালীগঞ্জ শহরে নিজের বাসার নিচে কুপিয়ে হত্যা করে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। আরিফুল কালীগঞ্জের সাবেক এমপি মান্নানের অনুসারী ছিলেন। এ ঘটনায় এখনো আনার ও তার সহযোগীদের হুমকি-ধমকির মধ্যে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন আরিফুলের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।

আরিফুলের স্ত্রী রেশমা লস্কর খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমপি আনার খুনিদের প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছেন। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, যদি আবার মনোনয়ন পান, তাহলে আমাকে মারতে মারতে মামলা তুলতে (প্রত্যাহার) নিয়ে যাবেন। আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে আছি।’

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দুপুরে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে পৌরসভা অডিটোরিয়ামে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা চলছিল। সে সভায় হামলা চালায় আনারের সমর্থকরা। তারা ১১ জনকে কুপিয়ে আহত করে। হামলায় মারা যান কোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনন্দমোহন ঘোষ। সেই ঘটনার মামলায় পরিবারের পক্ষ থেকে আনার ও সহযোগীদের আসামি করার আবেদন করা হলেও প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকে নিজেকে বাঁচান আনার। পরে তার সহযোগীদেরও মামলা থেকে বের করে আনেন।

আনন্দমোহন ঘোষের স্ত্রী রিংকু ঘোষ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার পাইনি। এলাকার মানুষদের মধ্যেও এ নিয়ে ক্ষোভ আছে। ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।’

আশির দশক থেকে ১৭-১৮ বছর নিয়ামতপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন আবু সাঈদ বিশ্বাস। তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। খবরের কাগজের কাছে নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে আবু সাঈদ বিশ্বাস বলেন, ‘২০১৭ সালে স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশে আমাকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসায় আনার। আমাকে তুলে নিয়ে আট দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে নির্যাতন চালায়। সে নির্যাতনে স্ট্রোক হয়ে আমার শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গেছে। গত অক্টোবরে সেই মামলার রায়ের পর আমাকে জেলে যেতে হয়। গত সোমবার আমি জেল থেকে জামিনে বের হয়েছি।’

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আনোয়ারুল আজিম আনারকে কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন খান। আয়ুব নব্বইয়ের দশকে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন ও দলের দুর্দিনে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেছেন। বর্তমানে তিনিও আনারের জুলুমের শিকার।

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন খান গত বুধবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমিসহ কালীগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়নের নেতা-কর্মী নির্যাতিত। আমার ইজারা নেওয়া বাঁওড় জোর করে দখল করে নিয়েছে সে। আমাকে মিথ্যা চেক জালিয়াতির মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। কালীগঞ্জের সবাই এ বিষয়ে জানে।’

আয়ুব হোসেন খান বলেন, ‘কালীগঞ্জের সংখ্যালঘুরা আনারের দ্বারা নির্যাতিত। তারা আতঙ্কে আছে। সবাই মনে করছে, সে যদি আবার এমপি হয় তাহলে সবাইকে এলাকাছাড়া হতে হবে।’

২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদ ইকবাল শিপন মৃধাকে এক বৈঠকে আনোয়ারুল আজিম নিজেই মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে আজাদ ইকবাল শিপন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই শেখের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুর রহমান একসময়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আনারের হাতে পুরোনো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রায় সবাই নির্যাতিত। তার ভাগ্নে বারবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ আমাকেও মারধর করেছে।’

নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কবির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার চাচা প্রায় ২৩ বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর জানাজা আটকে দিয়েছিলেন আনার। তিনি দাবি করেছিলেন আমার চাচার কাছে টাকা পান। অথচ চাচা জীবিত অবস্থায় কোনোদিন শুনিনি আনার টাকা পাবেন।’

বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক

২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর গঠিত ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ছিলেন পিকুল হোসেন। তাকে গত বছর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার প্রভাব খাটিয়ে পিকুলকে সাধারণ সম্পাদক করেন।

আনোয়ারুল আজিম আনারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেন কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শিবলী নোমানী। এই নোমানীর বাবা মোমিন মৌলভি তালিকাভুক্ত রাজাকার। এ বছর যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর মৃত্যুর পর ফেসবুকে শোক জানিয়েছিলেন শিবলী নোমানী।

কোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন বাদশা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, দলের লোকেরা কেউ আনারের সঙ্গে নেই। যারা জীবনে কখনো জয় বাংলা বলেনি তাদের নিয়ে চলেন আনার।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আনারের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করছেন আব্দুর রউফ। এই রউফ বিএনপির এমপি শহীদুজ্জামান বেল্টুর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগেও গোলাম রসুল পরিচিত ছিলেন জামায়াতের ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে। এখন তিনি সংসদ সদস্য আনারের ঘনিষ্ঠজন। আনারের ছত্রচ্ছায়ায় কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ সরকারি সুগার মিলে সিন্ডিকেট গড়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গোলাম রসুল।

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন খান বলেন, ‘পৌর জামায়াতের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন গোলাম রসুল। তাকে সুগার মিলের নেতৃত্বে এনে কোটিপতি বানিয়েছেন আনার।’

শিক্ষক পিটিয়ে আলোচনায়

গত বছরের মে মাসে এক কলেজশিক্ষককে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন আনোয়ারুল আজিম আনার। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজে ঢুকে এক শিক্ষককে মারধর এবং আরেক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেন আনার ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় সেদিনেই কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান ঝিনাইদহের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এমপি আনার গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনকে চড়থাপ্পড় মারেন। এতে ওই শিক্ষকের কান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
 
নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কবির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যে শিক্ষককে পিটিয়েছেন তার বাড়ি আমাদের ইউনিয়নে। এ ঘটনায় ইউনিয়নের লোকেরা ক্ষুব্ধ। আনার যদি আবারও মনোনয়ন পায় তাহলে আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের লোকেরাও তাকে ভোট দেবে না।’

ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, ২০০৭ সালে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। সে সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গা-ঢাকা দেন আনোয়ারুল আজিম আনার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৫টি মামলা ছিল। এসব মামলায় তিনি ফেরারি আসামি ছিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান ও অর্থ পাচার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে তার নাম ছিল ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায়। সে সময়ে একাধিক গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।

অভিযোগের জবাবে যা বললেন আনার 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের কিছু লোক বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়ে দলের জন্য বদনাম এনেছে। তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি। সে কারণে তারা এখন আমার বিরুদ্ধে নানা বানোয়াট অভিযোগ দিচ্ছে। যেগুলোর কোনো সত্যতা নেই।’

ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘তখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়। আমার নামে রাজনৈতিক কারণে অনেক মামলা ছিল। পরে সেগুলো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করেছি।’

রাজাকার-সন্তান শিবলী নোমানীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘শিবলীর বাবার কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু শিবলী ছাত্রলীগ করেছে, এখন যুবলীগের দায়িত্বে আছে।’

দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-নির্যাতনের প্রসঙ্গে আনার বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিইনি। কেউ অপরাধ করে থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় তার সাজা হবে, সেটা স্বাভাবিক।’ কলেজশিক্ষককে পেটানোর অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন আনার।

সালমান/

এমপি আনার হত্যাকাণ্ড: ঝিনাইদহের ১৩ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গ্রেপ্তারে নানা হিসাব-নিকাশ

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:২৮ পিএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩২ পিএম
এমপি আনার হত্যাকাণ্ড: ঝিনাইদহের ১৩ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গ্রেপ্তারে নানা হিসাব-নিকাশ
এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় জড়িত থাকার সন্দেহে জেলার ১৩ জন নেতাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এর মধ্যে ৯ জনকে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল। বাকি ৪ জনকে ঝিনাইদহ জেলায় গিয়ে ডিবির টিম জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান তদন্তকারীরা। তাদের তথ্যের সূত্র ধরে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। 

এই ১৩ নেতা ঝিনাইদহ জেলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। কেউ যুবলীগ, কেউ ছাত্রলীগ আবার কেউ স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা। এদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কারণ এমপি আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করীম মিন্টুকে গ্রেপ্তার দেখানোর পর ডিবির অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। তাকে গ্রেপ্তার করার পর বড় চাপে পড়ে পুলিশ। তাকে ছাড়াতে নানা পর্যায় থেকে তদবির আসে। এতে মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। এ জন্য এ মামলায় যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে তদন্তকারীদের।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্র জানায়, ডিবির ছায়া তদন্তে আনার হত্যার ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। এরপরই আস্তে আস্তে উপরের নামগুলো বের হয়ে আসে।

এদিকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সীতাকুণ্ডু থেকে গ্রেপ্তার আসামি ফয়সাল আলী সাহাজী।

৬ দিনের রিমান্ড শেষে বুধবার (৩ জুলাই) ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে এ জবানবন্দি দেন তিনি। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান এ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন।

এর আগে গত মঙ্গলবার এই মামলার আরেক আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ফকির আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামি ফয়সাল এর আগে ডিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন যে, আনারকে হত্যার সময় শাহীন মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন।

এ সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় চিৎকার করে বলছিলেন যে, তাকে (আনার) দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন খুনিরা আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার আসামি ফয়সাল ও মোস্তাফিজুর চিকিৎসা ভিসার মাধ্যমে ভারতে গিয়েছিলেন। ডিবি পুলিশ তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চেয়েছিল যে, তাদের শরীরে কোনো রোগ আছে কিনা? তারা ডিবিকে জানিয়েছেন যে, তাদের কোনো রোগ নেই। একটা অজুহাত দেখিয়ে তারা ভারতে চিকিৎসা ভিসা নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের দুজনের মোবাইল জব্দ করেছে ডিবি। এসব মোবাইলে তারা কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তার রেকর্ড পরীক্ষা করা হচ্ছে। এদিকে খুনের মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে সহসাই দেশে ফেরানো যাচ্ছে না। এর জন্য বাংলাদেশের গোয়েন্দারা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন এমপি আনার। ২২ মে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন।

অন্যদিকে কলকাতায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ দুটি মামলায় ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭ জন। 

তারা হলেন শিলাস্তি রহমান, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভুঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজি, ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল সাহাজী।

এশিয়ান হাইওয়ে গতিশীলে চীন-ভারতের সহযোগিতা দরকার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৫ এএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:৩২ পিএম
এশিয়ান হাইওয়ে গতিশীলে চীন-ভারতের সহযোগিতা দরকার
ছবি : খবরের কাগজ

এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক (এএইচ) প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএন-এসক্যাপ) একটি সহযোগী প্রকল্প এটি। এই নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। এটি এশিয়ার ৩২টি দেশকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করবে। হাইওয়ের সঙ্গে রয়েছে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েও। এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগে সমঝোতা হওয়ার পর এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের প্রশ্ন, গত ৬৫ বছরে এই নেটওয়ার্ক কতটা এগোল। তবে বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সুফল পেতে হলে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্থল-বাণিজ্য অন্য উচ্চতায় উঠবে।

এ প্রসঙ্গে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেসব দেশ যুক্ত হয়েছে তারা এগিয়ে গেছে। যারা যুক্ত হয়নি তারা পিছিয়ে গেছে। আমাদের প্রথম যখন রুট প্রস্তাব করা হলো, আমাদের সেই রুট পছন্দ হলো না। এখন অবশ্য বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে। কিন্তু রুটগুলোর তেমন উন্নতি করেনি সরকার। ভারত আমাদের তিন দিকে বেষ্টন করে আছে বিধায় আমাদের ল্যান্ড কানেকটিভিটি খুবই দরকার।’

এই নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য ২০০৩ সালে ব্যাংককে একটি আন্তসরকার চুক্তি হয়। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়। এটি এমন একটি রুট, যেটি ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। এর শুরু জাপানের টোকিও থেকে, শেষ ইউরোপে- মিশবে গিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে।

অন্যদিকে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে হলো ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে একটি সমন্বিত মালবাহী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির একটি প্রকল্প। এটিও ইউএন-এসক্যাপের একটি সহযোগী প্রকল্প। এটিও একই সময়ে শুরু হয়েছিল। 

ইউএন-এসক্যাপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক হলো একটি আঞ্চলিক পরিবহন সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম, যার লক্ষ্য এশিয়ায় সড়ক অবকাঠামোর দক্ষতা ও উন্নয়ন বাড়ানো। এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং প্রধান উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর সঙ্গে এই অঞ্চলের জন্য একটি আন্তর্জাতিক, সমন্বিত, মাল্টিমোডাল পরিবহন এবং লজিস্টিক সিস্টেমের বিকাশ দেখা এসক্যাপের সামগ্রিক লক্ষ্যের অংশ। এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এখন ৩২টি দেশের মধ্য দিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে গঠিত।

এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতি দুই বছর পরপর গ্রুপের বৈঠক হয়। এটি চুক্তির বাস্তবায়ন বিবেচনা করে এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক চালু করার বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি বিবেচনা করে।

এসক্যাপ অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা এবং পরিবহন সুবিধার ব্যবস্থার প্রচার, পরিবহন নীতি, চুক্তি, কর্মসূচি এবং প্রকল্পগুলোকে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায়ে প্রণয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলজুড়ে রাস্তার মাধ্যমে পণ্য ও যানবাহনের দক্ষ ও মসৃণ চলাচল সমর্থন করে। এই লক্ষ্যে এসক্যাপ আটটি পরিবহন সুবিধা মডেল তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক সড়ক পরিবহন সুবিধার জন্য আঞ্চলিক কৌশলগত কাঠামোর সঙ্গে তারা ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং এই অঞ্চলে বিরামহীন আন্তর্জাতিক সড়ক পরিবহন ও সরবরাহ সক্ষম করে।

যে ৩২টি দেশ যুক্ত হয়েছে
নেটওয়ার্কটির মোট দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। এই নেটওয়ার্কে আছে আফগানিস্তান (৪,২৪৭ কিলোমিটার), আর্মেনিয়া (৯৫৮ কিলোমিটার), আজারবাইজান (১,৪৪২ কিলোমিটার), বাংলাদেশ (১,৮০৪ কিলোমিটার), ভুটান (১ কিলোমিটার), কম্বোডিয়া (১,৩৩৯ কিলোমিটার), চীন (২৫,৫৭৯ কিলোমিটার), জর্জিয়া (১,১৫৪ কিলোমিটার), হংকং (৯১ কিলোমিটার), ভারত (২৭,৯৮৭ কিলোমিটার), ইন্দোনেশিয়া (৩,৯৮৯ কিলোমিটার), ইরান (১১,১৫২ কিলোমিটার), জাপান (১,২০০ কিলোমিটার), কাজাখস্তান (১৩,১৮৯ কিলোমিটার) এবং উত্তর কোরিয়া (১,৩২০ কিলোমিটার)।

৩২টি দেশের মধ্যে আরও যেসব দেশ রয়েছে সেগুলো হলো দক্ষিণ কোরিয়া (৯০৭ কিলোমিটার), কিরগিজস্তান (১,৬৯৫ কিলোমিটার), লাওস (২,২৯৭ কিলোমিটার), মালয়েশিয়া (৪,০০৬ কিলোমিটার), মঙ্গোলিয়া (৪,২৮৬ কিলোমিটার), মায়ানমার (৩,০০৩ কিলোমিটার), নেপাল (১,৩২১ কিলোমিটার), পাকিস্তান (৫,৩৭৭ কিলোমিটার), ফিলিপাইন (৩,৫১৭ কিলোমিটার), রাশিয়া (১৬,৮৬৯ কিলোমিটার), সিঙ্গাপুর (৩৮ কিলোমিটার), শ্রীলঙ্কা (৬৫০ কিলোমিটার), তাজিকিস্তান (১,৯২৫ কিলোমিটার), থাইল্যান্ড (৫,১১২ কিলোমিটার), তুরস্ক (৫,২৫৪ কিলোমিটার), তুর্কমেনিস্তান (২,২০৪ কিলোমিটার), উজবেকিস্তান (২,৯৬৬ কিলোমিটার) এবং ভিয়েতনাম (২,৬৬৪ কিলোমিটার)। 

বাংলাদেশ যেদিক দিয়ে যুক্ত হবে
ম্যাপ অনুযায়ী, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে ৪৪টি পৃথক রুট রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি রুট (এএইচ১- তামাবিল-বেনাপোল ৪৯২ কিলোমিটার, এএইচ২- তামাবিল-বাংলাবান্ধা ৫১৭ কিলোমিটার এবং এএইচ৪১- টেকনাফ-মোংলা ৭৬২ কিলোমিটার) পড়েছে বাংলাদেশে। বর্তমানে তিনটি রুটের কাজই চলমান। তবে শেষ হতে অনেক দেরি হবে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, তিনটি রুটই রাজধানী ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। দুটি রুট দুই প্রান্তে ভারতকে সংযুক্ত করবে। অন্য রুট অর্থাৎ এএইচ৪১ বাংলাদেশের মধ্যে আছে, তবে টেকনাফ দিয়ে মায়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেওয়া হতে পারে।

নেটওয়ার্কটি তৈরির উদ্দেশ্য
ইউএন-এসক্যাপের ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়, এটি করার মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতায় সামাজিক অগ্রগতি এবং জীবনযাত্রার উন্নত মানকে উন্নীত করবে, যেমনটি জাতিসংঘের সনদের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংযুক্তির ফলে ব্যবসার প্রসার, বিনিয়োগ ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ট্রানজিট ইত্যাদি সুফল প্রত্যাশা করা হয়। এটি একটি আঞ্চলিক পরিবহন সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম, যার লক্ষ্য এশিয়ায় সড়ক অবকাঠামোর দক্ষতা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি করা। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, এশিয়ার দেশগুলো ছোট ছোট ব্লকে নিজেদের মতো করে একটি মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটি তৈরি করে উদার বাণিজ্যের পথ তৈরি করবে- এমনটিই ছিল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের লক্ষ্য। বৈষম্যহীন অর্থনীতির জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা আরও সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছিল। এতে প্রতিটি দেশ উপকারভোগী হবে। একটি দেশের পণ্য অন্য দেশে সহজে পরিবহন করা যাবে, এতে নেটওয়ার্কে থাকা সব দেশ উপকারভোগী হবে।

তহবিল
এই প্রকল্পের বেশির ভাগ তহবিল আসে উন্নত এশীয় দেশ যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে।

তবে মহা উৎসাহ ও ধুমধামের সঙ্গে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তহবিল কমে আসতে থাকে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বলতে গেলে হিমঘরেই চলে গেছে এখন প্রকল্পটি। প্রকল্পের কাজ আবার কবে শুরু হবে, তা কেউ বলতে পারে না। 

বাংলাদেশের লাভ কী
এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের লাভ না ক্ষতি হবে, সেটি নিয়ে ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হওয়ার সময় থেকে বিতর্ক চলে আসছে। চুক্তি সইয়ের পর পরই বিরোধীরা তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত করেন। 
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হলে বাংলাদেশই লাভবান হবে। বিরোধীরা যে সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগ করছেন, প্রকৃত অর্থে বিষয়টি তেমন নয়। 

বুয়েট অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলছেন, ‘কোস্টাল বেল্টে থাকা বাংলাদেশ এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশ মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর করল, তা কেবল তো নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য না। এই বন্দর ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেন তাদের পণ্য পরিবহন করতে পারে, সে জন্য এশিয়ান নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।’

এশিয়ান হাইওয়ের সম্ভাবনা অনেক। আন্তদেশীয় সীমান্তজুড়ে মোটর ভেহিক্যাল ও ট্রান্স-এশিয়ান রেল সংযোগ হলে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যয় সাশ্রয়ে বড় সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে পণ্য পরিবহনের সময়ও কমবে।

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে তহবিল সংকটে এক রকম বন্ধই হয়ে আছে প্রকল্পের কাজ। বাংলাদেশের মধ্যে ১ হাজার ৮০৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে ৩০০ কিলোমিটারেরও কম অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যদের মতো বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও উদ্যোগের অভাবে এ প্রকল্প আর এগোয়নি। যেমন কুনমিং পর্যন্ত যেতে মায়ানমারের অভ্যন্তরের সংযোগ সড়ক পর্যন্ত একটি ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। চীন রাস্তাটি তৈরি করতে রাজি হয়েছিল, সম্মতি দিয়েছিল মায়ানমারও। কিন্তু গত দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করতে অসম্মতি জানায়। কাজটি করা গেলে বাংলাদেশ সরাসরি কুনমিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারত।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এটিও বলছেন, ভারতের কারণে এ প্রকল্প থমকে গেছে। চীনের মতো ভারতেরও সুযোগ ছিল এই আঞ্চলিক সংযোগ নিশ্চিতের নেতৃত্ব দেওয়ার। কিন্তু দেশটি তা করেনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ উদ্যোগটি স্থবির হয়ে আছে। এই দীর্ঘ সময়ে এ উদ্যোগের অগ্রগতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে আমাদের অনেকগুলো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর সংযোগ করে দিলেই হবে। কিন্তু সীমান্তে এসব অবকাঠামোর আন্তদেশীয় সংযোগের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না।’

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আমরা যখন আসিয়ানের দিকে তাকাই, তখন দেখি বিগ ব্রাদার তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বার্থে ছোট দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। কিন্তু এশিয়ান হাইওয়ে কানেকটিভিটিতে দেখছি, এখানে এলওসি প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ নিয়ে নানা জটিলতা থাকছে। আমাদের লোন টানতে হচ্ছে। এখানে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ভারত কেবল যদি নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে, যদি কেবল তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করতে চায়, তখনই তো এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পে ভাটা পড়ে।’

শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ৫ দফা অদল-বদলের পর আবার দ্বন্দ্ব

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৯ এএম
শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ৫ দফা অদল-বদলের পর আবার দ্বন্দ্ব
শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঁচ দফা নাম ও মালিকানা অদল-বদলের পর আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়াল রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

একটি ট্রাস্টের আওতায় পরিচালিত এই হাসপাতালটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব দাবিদার ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরীর সাম্প্রতিক তৎপরতাকে ঘিরে নতুন দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে উঠে এসেছে।

গত ২৭ জুন ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী ওই কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে অধ্যক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন অধ্যক্ষ কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। এ ছাড়া তিনি স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।

এই হাসপাতালের পেছনের ঘটনাপ্রবাহ খুঁজে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির সরকারের আমলে লিবিয়াফেরত কিছু ব্যক্তির অর্থায়নে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তায় রাজধানীর মিরপুরে উম্মাহ ট্রাস্ট তৈরি করে একটি হাসপাতাল চালু করা হয়। পরে ১৯৯৪-৯৫ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে বিএনপি-সমর্থিত একটি গ্রুপ নিজেদের দখলে নিয়ে এটির নাম পরিবর্তন করে ভাসানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নাম দেয়। 

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিমের সহায়তায় একদল চিকিৎসক এই প্রতিষ্ঠানটিকে মিরপুর থেকে উত্তরায় স্থানান্তর করে শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামকরণ করেন। তখন এর প্রকল্প পরিচালক করা হয় স্বাচিপের বর্তমান সভাপতি ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরীকে।

সরকারের পালাবদলের মধ্য দিয়ে ২০০১ সালের অক্টোবরের পর আবার নাম পরিবর্তন করে মওলানা ভাসানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নাম দেওয়া হয় এবং মওলানা ভাসানী ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ট্রাস্টের ও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মনোনীত হন মোসাদ্দেক হোসেন। পরে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলেজের নাম শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ পুনঃপ্রর্বতন করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে মওলানা ভাসানী ট্রাস্ট থেকে মনসুর আলী ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসা হয়।

এ সময় ট্রাস্টের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মনোনীত হন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মো. নাসিমের পত্নী লায়লা আরজুমান্দ এবং সদস্যসচিব হন ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী। এভাবে চলার একপর্যায়ে ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরীকে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়। কমিটিতে চেয়ারম্যান পদে লায়লা আরজুমান্দ রয়ে যান এবং সদস্যসচিব হন বর্তমান এমপি মো. নাসিমের বড় সন্তান তানভীর শাকিল জয়। আর পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হন মেজো সন্তান তমাল মনসুর। এখন পর্যন্ত এভাবেই চলে আসছে।

তবে গত ২৭ জুন দুপুরে বর্তমান স্বাচিপ সভাপতি ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী হঠাৎ করেই উত্তরার শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেনের রুমে ঢুকে নিজেকে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব দাবি করে ওই ভবনে নিজের জন্য একটা অফিস রুম রেডি করে দিতে বলেন। একই সঙ্গে সদস্যসচিব হিসেবে এখন থেকে কলেজ পরিচালনায় তার কাছে সব ধরনের জবাবদিহি ও অনুমোদন নেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেন। ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী ও ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন দুজনই খবরের কাগজের কাছে এই তথ্য সত্য বলে স্বীকার করেন।

ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী দাবি করেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া হলেও এখনো জয়েন্ট স্টকে কাগজে-কলমে ট্রাস্টের সদস্যসচিব পদে তার নামই রয়ে গেছে। ফলে তিনি এখনো বৈধ সদস্যসচিব আছেন এবং এ জন্যই তিনি তার বৈধ দায়িত্ব বুঝে নিতে ক্যাম্পাসে গেছেন এবং যাবেন। তিনি কোনো অন্যায় করেননি।

অন্যদিকে ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, স্বাচিপ সভাপতি নিজের পদ দাবি করে তার কাছে জবাবদিহি করার জন্য চাপ দেন। পাশাপাশি স্বাচিপ সভাপতির সঙ্গে থাকা অন্যরা তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। ফলে বিষয়টি তিনি বোর্ডের সেক্রেটারি ও সংসদ সদস্য তানভীর শাকিলকে অবহিত করেন এবং উত্তরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবরেও বিষয়টি লিখিত দিয়েছেন। 

এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্বাচিপ সভাপতি নিজেকে যেভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব বা সম্পাদক দাবি করছেন সেটা ঠিক নয়। তিনি ভুল বলছেন। কারণ ২০১৫ সালেই ট্রাস্টি বোর্ডের পরিবর্তন করে আমাকে সেক্রেটারি করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনা আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন বিষয়টি যাতে আর সামনে না এগোয়, সেভাবে তিনি দেখবেন।’

বেনজীর পরিবার : উৎসের খোঁজ নেই আরও অর্ধশত কোটি টাকার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৮:০০ এএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৮:০০ এএম
বেনজীর পরিবার : উৎসের খোঁজ নেই আরও অর্ধশত কোটি টাকার
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী জীশান মীর্জা

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের উৎসবিহীন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করা অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। স্থাবর সম্পদগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য যাচাই করে সব অর্থ-সম্পদের প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করা হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অগ্রগতি প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা শেষে আগামী সপ্তাহে হাইকোর্টে দাখিল করা হতে পারে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

বুধবার (৩ জুলাই) দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুদক থেকে অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠানো হলে তা আগামী ১০ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চে দাখিল করা হবে।’

অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত দালিলিক প্রমাণ অনুযায়ী বেনজীর আহমেদের উৎসবিহীন ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা, তার স্ত্রী জীশান মীর্জার ২১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা, মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীরের ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা ও ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এ ছাড়া বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১৯৬টি দলিলে ঢাকায় ১২টি ফ্ল্যাট, দেশের বিভিন্ন জেলায় ৬৯৭ বিঘা জমি, মৎস্য ও গরুর খামার, রিসোর্ট, বিও অ্যাকাউন্টসহ ৩৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সিটিজেন টেলিভিশনসহ পাঁচটি পূর্ণ মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আটটি ব্যবসায়িক শেয়ার রয়েছে। বিচারিক আদালতের নির্দেশে এসব অর্থ-সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়েছে। 

দুদক সূত্র জানায়, বেনজীর আহমেদের ক্রোক বা ফ্রিজ করা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের আনুমানিক মূল্য ১ হাজার কোটি টাকা। দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে ওই সম্পদগুলোর মধ্যে বৈধ ও অবৈধ উৎস নিরূপণ করা হচ্ছে। চূড়ান্ত যাচাই ও পর্যালোচনা শেষে বলা যাবে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ কত এবং বৈধ সম্পদের পরিমাণ কত। 

হাইকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বেনজীরের অবৈধ সম্পদসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করে ১০ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে অগ্রগতি দিতে গত এপ্রিল মাসে আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদেশের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এই আদেশ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, আগামী ১০ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন আকারে অগ্রগতি জানাতে হবে।

গত ২১ এপ্রিল বেনজীরের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের কমিটি করে দুদক। এর এক দিন পর ২৩ এপ্রিল এক আদেশে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে দুই মাস সময় বেঁধে দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চ। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর আদেশের কপি পায় দুদক। 

এদিকে বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের হিসাব চেয়ে ২১ দিন সময় বেঁধে দিয়ে গত মঙ্গলবার নোটিশ জারি করেছে দুদক। এই নোটিশের প্রক্রিয়া শেষে মামলা দায়েরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।

কিলিং মিশন শেষে সিয়ামের সঙ্গে নেপাল গিয়েছিলেন ফয়সাল

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১১:০৯ এএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১১:১৭ এএম
কিলিং মিশন শেষে সিয়ামের সঙ্গে নেপাল গিয়েছিলেন ফয়সাল
মোস্তাফিজুর রহমান-ফয়সাল আলী সাহাজী-সিয়াম

কলকাতার সঞ্জিবা গার্ডেনে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বিভিন্ন স্থানে গা-ঢাকা দেন খুনিরা। এ খুনের মাস্টারমাইন্ড আকতারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। অপর কিলার জিহাদ কলকাতায় গা-ঢাকা দেন। বাকিরা পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। খুনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে সিয়াম নেপালে পালিয়ে যান। এ সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ফয়সাল সাহাজীও নেপালে সিয়ামের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে তিনি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। 

নেপালের ‘গন্ডকীর দুলিয়া’ নামক এলাকায় সিয়াম তার এক পূর্ব পরিচিত সুপারি ব্যবসায়ীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সিয়াম ওই ব্যবসায়ীকে বলেছিলেন যে, ফয়সাল তার বন্ধু। তার কাছে বেড়াতে এসেছে। এতে ওই ব্যবসায়ী কিছুই বুঝতে পারেননি। নেপালে যাওয়ার পর সিয়ামের অর্থ ফুরিয়ে এসেছিল। সিয়াম তখন ফয়সালকে কলকাতা ফেরত যাওয়ার নিদের্শ দেন। 

পরে ফয়সাল কলকাতায় এসে তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া মোস্তাফিজুর রহমান ফকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। বাংলাদেশে এসে প্রথমে ঝালকাঠি এবং পরে সীতাকুণ্ডের একটি মন্দিরে আত্মগোপন করেন। পরে ঢাকার ডিবি পুলিশ প্রযুক্তির সহযোগিতায় তাদের দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে নেপাল পুলিশ সিয়ামকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সিয়াম এখন কলকাতার জেল-হাজতে রয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
 
গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন এমপি আনার। ২২ মে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। অন্যদিকে কলকাতায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। 

এ দুটি মামলায় ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭ জন। তারা হলেন- শিলাস্তি রহমান, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভুঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজি, ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল সাহাজী। 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যার ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়। যেহেতু এই মামলার পিও (ঘটনাস্থল) কলকাতা, সেহেতু এই মামলার মূল তদন্ত করছে কলকাতা পুলিশ। যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক কলকাতায় খুন হয়েছেন এ জন্য ডিবি পুলিশ শুধু ছায়া তদন্ত করছে। তাই খুনের মোটিভ কী আসে এর জন্য কলকাতা পুলিশের দিকে লক্ষ রয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের। এ ছাড়াও আনারের পরিবার কলকাতায় যাওয়ার পর ডিএনএ পরীক্ষার কী ফল আসে তার দিকেও নজর রয়েছে ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। 

সূত্র জানায়, কলকাতায় আনার হত্যার পর ঢাকার ডিবির পক্ষ থেকে ছায়া তদন্ত শুরু হয়। শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণ মামলা হওয়ার পর এই তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের খুব শিগগির আবার কলকাতায় যাওয়ার কথা রয়েছে। ডিবির দল কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশে আনার হত্যাকাণ্ডের ছায়া তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কলকাতায় পুলিশ অবহিত করবে। 

মোস্তাফিজুরের দায় স্বীকার

হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে করা মামলার অন্যতম আসামি মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল এই জবানবন্দি দেন তিনি। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

গ্রেপ্তার মোস্তাফিজুর রহমান স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় পুলিশ এদিন আদালতে তাকে হাজির করে। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান তা রেকর্ড করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত। এ নিয়ে এই মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন আদালতে জবানবন্দি দিলেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গত ২৬ জুন আনার হত্যায় জড়িত ফয়সাল আলী সাহাজী ও মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। পরের দিন ২৭ জুন আদালত তাদের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।