এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক (এএইচ) প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএন-এসক্যাপ) একটি সহযোগী প্রকল্প এটি। এই নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। এটি এশিয়ার ৩২টি দেশকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করবে। হাইওয়ের সঙ্গে রয়েছে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েও। এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগে সমঝোতা হওয়ার পর এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের প্রশ্ন, গত ৬৫ বছরে এই নেটওয়ার্ক কতটা এগোল। তবে বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সুফল পেতে হলে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্থল-বাণিজ্য অন্য উচ্চতায় উঠবে।
এ প্রসঙ্গে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেসব দেশ যুক্ত হয়েছে তারা এগিয়ে গেছে। যারা যুক্ত হয়নি তারা পিছিয়ে গেছে। আমাদের প্রথম যখন রুট প্রস্তাব করা হলো, আমাদের সেই রুট পছন্দ হলো না। এখন অবশ্য বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে। কিন্তু রুটগুলোর তেমন উন্নতি করেনি সরকার। ভারত আমাদের তিন দিকে বেষ্টন করে আছে বিধায় আমাদের ল্যান্ড কানেকটিভিটি খুবই দরকার।’
এই নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য ২০০৩ সালে ব্যাংককে একটি আন্তসরকার চুক্তি হয়। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়। এটি এমন একটি রুট, যেটি ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। এর শুরু জাপানের টোকিও থেকে, শেষ ইউরোপে- মিশবে গিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে।
অন্যদিকে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে হলো ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে একটি সমন্বিত মালবাহী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির একটি প্রকল্প। এটিও ইউএন-এসক্যাপের একটি সহযোগী প্রকল্প। এটিও একই সময়ে শুরু হয়েছিল।
ইউএন-এসক্যাপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক হলো একটি আঞ্চলিক পরিবহন সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম, যার লক্ষ্য এশিয়ায় সড়ক অবকাঠামোর দক্ষতা ও উন্নয়ন বাড়ানো। এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং প্রধান উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর সঙ্গে এই অঞ্চলের জন্য একটি আন্তর্জাতিক, সমন্বিত, মাল্টিমোডাল পরিবহন এবং লজিস্টিক সিস্টেমের বিকাশ দেখা এসক্যাপের সামগ্রিক লক্ষ্যের অংশ। এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এখন ৩২টি দেশের মধ্য দিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে গঠিত।
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতি দুই বছর পরপর গ্রুপের বৈঠক হয়। এটি চুক্তির বাস্তবায়ন বিবেচনা করে এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক চালু করার বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি বিবেচনা করে।
এসক্যাপ অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা এবং পরিবহন সুবিধার ব্যবস্থার প্রচার, পরিবহন নীতি, চুক্তি, কর্মসূচি এবং প্রকল্পগুলোকে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায়ে প্রণয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলজুড়ে রাস্তার মাধ্যমে পণ্য ও যানবাহনের দক্ষ ও মসৃণ চলাচল সমর্থন করে। এই লক্ষ্যে এসক্যাপ আটটি পরিবহন সুবিধা মডেল তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক সড়ক পরিবহন সুবিধার জন্য আঞ্চলিক কৌশলগত কাঠামোর সঙ্গে তারা ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং এই অঞ্চলে বিরামহীন আন্তর্জাতিক সড়ক পরিবহন ও সরবরাহ সক্ষম করে।
যে ৩২টি দেশ যুক্ত হয়েছে
নেটওয়ার্কটির মোট দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। এই নেটওয়ার্কে আছে আফগানিস্তান (৪,২৪৭ কিলোমিটার), আর্মেনিয়া (৯৫৮ কিলোমিটার), আজারবাইজান (১,৪৪২ কিলোমিটার), বাংলাদেশ (১,৮০৪ কিলোমিটার), ভুটান (১ কিলোমিটার), কম্বোডিয়া (১,৩৩৯ কিলোমিটার), চীন (২৫,৫৭৯ কিলোমিটার), জর্জিয়া (১,১৫৪ কিলোমিটার), হংকং (৯১ কিলোমিটার), ভারত (২৭,৯৮৭ কিলোমিটার), ইন্দোনেশিয়া (৩,৯৮৯ কিলোমিটার), ইরান (১১,১৫২ কিলোমিটার), জাপান (১,২০০ কিলোমিটার), কাজাখস্তান (১৩,১৮৯ কিলোমিটার) এবং উত্তর কোরিয়া (১,৩২০ কিলোমিটার)।
৩২টি দেশের মধ্যে আরও যেসব দেশ রয়েছে সেগুলো হলো দক্ষিণ কোরিয়া (৯০৭ কিলোমিটার), কিরগিজস্তান (১,৬৯৫ কিলোমিটার), লাওস (২,২৯৭ কিলোমিটার), মালয়েশিয়া (৪,০০৬ কিলোমিটার), মঙ্গোলিয়া (৪,২৮৬ কিলোমিটার), মায়ানমার (৩,০০৩ কিলোমিটার), নেপাল (১,৩২১ কিলোমিটার), পাকিস্তান (৫,৩৭৭ কিলোমিটার), ফিলিপাইন (৩,৫১৭ কিলোমিটার), রাশিয়া (১৬,৮৬৯ কিলোমিটার), সিঙ্গাপুর (৩৮ কিলোমিটার), শ্রীলঙ্কা (৬৫০ কিলোমিটার), তাজিকিস্তান (১,৯২৫ কিলোমিটার), থাইল্যান্ড (৫,১১২ কিলোমিটার), তুরস্ক (৫,২৫৪ কিলোমিটার), তুর্কমেনিস্তান (২,২০৪ কিলোমিটার), উজবেকিস্তান (২,৯৬৬ কিলোমিটার) এবং ভিয়েতনাম (২,৬৬৪ কিলোমিটার)।
বাংলাদেশ যেদিক দিয়ে যুক্ত হবে
ম্যাপ অনুযায়ী, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে ৪৪টি পৃথক রুট রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি রুট (এএইচ১- তামাবিল-বেনাপোল ৪৯২ কিলোমিটার, এএইচ২- তামাবিল-বাংলাবান্ধা ৫১৭ কিলোমিটার এবং এএইচ৪১- টেকনাফ-মোংলা ৭৬২ কিলোমিটার) পড়েছে বাংলাদেশে। বর্তমানে তিনটি রুটের কাজই চলমান। তবে শেষ হতে অনেক দেরি হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, তিনটি রুটই রাজধানী ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। দুটি রুট দুই প্রান্তে ভারতকে সংযুক্ত করবে। অন্য রুট অর্থাৎ এএইচ৪১ বাংলাদেশের মধ্যে আছে, তবে টেকনাফ দিয়ে মায়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেওয়া হতে পারে।
নেটওয়ার্কটি তৈরির উদ্দেশ্য
ইউএন-এসক্যাপের ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়, এটি করার মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতায় সামাজিক অগ্রগতি এবং জীবনযাত্রার উন্নত মানকে উন্নীত করবে, যেমনটি জাতিসংঘের সনদের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংযুক্তির ফলে ব্যবসার প্রসার, বিনিয়োগ ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ট্রানজিট ইত্যাদি সুফল প্রত্যাশা করা হয়। এটি একটি আঞ্চলিক পরিবহন সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম, যার লক্ষ্য এশিয়ায় সড়ক অবকাঠামোর দক্ষতা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, এশিয়ার দেশগুলো ছোট ছোট ব্লকে নিজেদের মতো করে একটি মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটি তৈরি করে উদার বাণিজ্যের পথ তৈরি করবে- এমনটিই ছিল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের লক্ষ্য। বৈষম্যহীন অর্থনীতির জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা আরও সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছিল। এতে প্রতিটি দেশ উপকারভোগী হবে। একটি দেশের পণ্য অন্য দেশে সহজে পরিবহন করা যাবে, এতে নেটওয়ার্কে থাকা সব দেশ উপকারভোগী হবে।
তহবিল
এই প্রকল্পের বেশির ভাগ তহবিল আসে উন্নত এশীয় দেশ যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে।
তবে মহা উৎসাহ ও ধুমধামের সঙ্গে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তহবিল কমে আসতে থাকে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বলতে গেলে হিমঘরেই চলে গেছে এখন প্রকল্পটি। প্রকল্পের কাজ আবার কবে শুরু হবে, তা কেউ বলতে পারে না।
বাংলাদেশের লাভ কী
এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের লাভ না ক্ষতি হবে, সেটি নিয়ে ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হওয়ার সময় থেকে বিতর্ক চলে আসছে। চুক্তি সইয়ের পর পরই বিরোধীরা তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত করেন।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হলে বাংলাদেশই লাভবান হবে। বিরোধীরা যে সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগ করছেন, প্রকৃত অর্থে বিষয়টি তেমন নয়।
বুয়েট অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলছেন, ‘কোস্টাল বেল্টে থাকা বাংলাদেশ এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশ মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর করল, তা কেবল তো নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য না। এই বন্দর ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেন তাদের পণ্য পরিবহন করতে পারে, সে জন্য এশিয়ান নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।’
এশিয়ান হাইওয়ের সম্ভাবনা অনেক। আন্তদেশীয় সীমান্তজুড়ে মোটর ভেহিক্যাল ও ট্রান্স-এশিয়ান রেল সংযোগ হলে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যয় সাশ্রয়ে বড় সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে পণ্য পরিবহনের সময়ও কমবে।
প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে তহবিল সংকটে এক রকম বন্ধই হয়ে আছে প্রকল্পের কাজ। বাংলাদেশের মধ্যে ১ হাজার ৮০৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে ৩০০ কিলোমিটারেরও কম অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যদের মতো বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও উদ্যোগের অভাবে এ প্রকল্প আর এগোয়নি। যেমন কুনমিং পর্যন্ত যেতে মায়ানমারের অভ্যন্তরের সংযোগ সড়ক পর্যন্ত একটি ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। চীন রাস্তাটি তৈরি করতে রাজি হয়েছিল, সম্মতি দিয়েছিল মায়ানমারও। কিন্তু গত দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করতে অসম্মতি জানায়। কাজটি করা গেলে বাংলাদেশ সরাসরি কুনমিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারত।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এটিও বলছেন, ভারতের কারণে এ প্রকল্প থমকে গেছে। চীনের মতো ভারতেরও সুযোগ ছিল এই আঞ্চলিক সংযোগ নিশ্চিতের নেতৃত্ব দেওয়ার। কিন্তু দেশটি তা করেনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ উদ্যোগটি স্থবির হয়ে আছে। এই দীর্ঘ সময়ে এ উদ্যোগের অগ্রগতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে আমাদের অনেকগুলো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর সংযোগ করে দিলেই হবে। কিন্তু সীমান্তে এসব অবকাঠামোর আন্তদেশীয় সংযোগের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না।’
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আমরা যখন আসিয়ানের দিকে তাকাই, তখন দেখি বিগ ব্রাদার তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বার্থে ছোট দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। কিন্তু এশিয়ান হাইওয়ে কানেকটিভিটিতে দেখছি, এখানে এলওসি প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ নিয়ে নানা জটিলতা থাকছে। আমাদের লোন টানতে হচ্ছে। এখানে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ভারত কেবল যদি নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে, যদি কেবল তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করতে চায়, তখনই তো এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পে ভাটা পড়ে।’