![যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি : ভয় নেই, সতর্ক থাকতে হবে](uploads/2023/12/01/1701411377.Garments.jpg)
বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নতুন নীতির বিষয়ে বাংলাদেশে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ এই নীতির ফলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনই কোনো প্রভাব পড়বে না। তা ছাড়া এই নীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। তবে কোনো বিপদ আসার আগে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৬ নভেম্বর শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন নীতি ঘোষণা করে। তাতে শ্রমিকের অধিকার হরণ, তাদের ভয়ভীতি দেখানো ও নির্যাতন করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে।
বাইডেন সরকারের এই নীতি ঘোষণার পর দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এবং তারা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতির ঘোষণা এমন একসময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে টানাপোড়েন ও পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন চলছে। ফলে স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট মহলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো কিংবা হুটহাট কোনো কিছু করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে না। সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
শ্রমসচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকার নীতিটি যেহেতু বিশ্বের সব দেশের জন্য করা হয়েছে, ফলে আমরা ভয়ের কিছু দেখছি না। শ্রম অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরামর্শ মেনে চলছে বাংলাদেশ।’ তবে শ্রমসচিব এও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নীতিটি নিয়ে আমরা সজাগ আছি।’
শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সব সময়ই সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের জন্য যে শ্রমনীতি করেছে, আমার কাছে মনে হয় না এ নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কিছু আছে।’
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাইডেন সরকারের মেমোরেন্ডামে কী রয়েছে, এখনো জানা যায়নি। শ্রম অধিকার প্রশ্নে করণীয় কিছু থাকলে তা অবশ্যই করা হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম মেনে চলে। কাজেই এটা নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
তাদের মতে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার তুলনায় ভালো। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম মেনে বাংলাদেশের পোশাকসহ রপ্তানিমুখী সব কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশের আইন শ্রমবান্ধব। ফলে বাইডেন সরকারের শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন নীতির কারণে অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপ আসতে পারে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
যোগাযোগ করা হলে তৈরি পোশাক ও রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিদ্দিকুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে সব মালিক, শ্রমিক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি। যখন যা প্রয়োজন হয়, তখন তাই করা হচ্ছে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’ বিজিএমইএর সাবেক এই নেতা আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ব্যবসায়িক অংশীদার। তারা কোনো পরামর্শ দিলে আমাদের শুনতে হবে।’
বিশেজ্ঞরা মনে করেন, একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তা হলো বাংলাদেশের শ্রম সস্তা। এর কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিতে আগ্রহী বেশি। কেননা ক্রেতারা যেখানে লাভ পাবেন, সেখানেই ব্যবসা করবেন। কাজেই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তারা যেখানে লাভবান হবেন, সেখানেই ব্যবসা করবেন। বাংলাদেশে পোশাক সস্তা। কারণ এ দেশে শ্রম সস্তা। কাজেই আমি মনি করি, বড় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে বিমুখ হবে না। শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই।’
জানা যায়, বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে দুটি কমিটি কাজ করছে। একটি হচ্ছে পার্টিসিপেটরি বা দ্বিপক্ষীয় কমিটি। অন্যটি ইউনিয়ন কমিটি। দ্বিপক্ষীয় কমিটিতে মালিক এবং শ্রমিকের একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকেন। প্রায় সব কারখানায় এ কমিটি আছে। অন্যদিকে সব কারখানায় ইউনিয়ন চর্চা না থাকলেও বেশির ভাগের রয়েছে। ফলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে এসব কমিটি সব সময় তৎপর রয়েছে। তবে এটা ঠিক, আমাদের এখানে দর-কষাকষির বা সিবিএ করার সুযোগ নেই। এটি যুক্তরাষ্ট্রেও নেই বলে জানান তিনি।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বলেছেন, তারা কেউ চায় না দেশীয় শিল্প ধ্বংস হোক। কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা চাই না শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তার পরও যদি বাইরে থেকে কোনো চাপ তৈরি হয়, তা হলে মালিকপক্ষকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। তবে মার্কিন শ্রম অধিকার সুরক্ষার সাম্প্রতিক নীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটা সারা বিশ্বের জন্য। বাংলাদেশের বড় সুবিধা হচ্ছে সস্তা শ্রম। এতে ক্রেতারা লাভবান হচ্ছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতির কারণে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কিংবা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না। তবে সরকারের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। বঞ্চিত না হয় ন্যায্য অধিকার থেকে।’
শ্রম অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। বলেন, ‘আমরা শ্রম অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও নিজেদের শ্রম আইন মেনে চলছি। ফলে আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন নীতি নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই। ইতোমধ্যে শ্রম অধিকার বিষয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।’ ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে আরও অনেক সংস্কার হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানা যায়, বর্তমানে দেশে সাড়ে তিন-চার হাজার পোশাক কারখানা সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে সব কারখানার সক্ষমতা সমান নয়। কিছু কারখানার সক্ষমতার ঘাটতি আছে। এদের সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক হিসাব না থাকলেও সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশ পোশাক কারখানার দুর্বলতা রয়েছে। বড় কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সব নিয়মকানুন মেনে চলতে পারলেও দুর্বল কারখানাগুলোর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে তা মেনে চলা সম্ভব নয়। পোশাক মালিকরা বলেছেন, যেসব কারখানার সক্ষমতার ঘাটতি আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সরকার কিছু প্রণোদনা দিতে পারে। তা হলে দুর্বল কারখানাগুলো টিকে যাবে। সূত্র বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার বিষয়ে যে নতুন নীতির কথা বলেছে, সেটা শুধু পোশাক খাতের জন্য নয়। এই নীতি দেশের রপ্তানিমুখী সব শিল্পের জন্য। কাজেই কোনো ধরনের বিপদ আসার আগে বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক থাকতে হবে। এ জন্য মালিক, শ্রমিক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তা সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী এসব শিল্প পরিচালিত হয়। কাজেই শ্রম অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র যে নীতির কথা বলেছে তাতে আমাদের উদ্বিগ্ন কিংবা ভয়ের কোনো কারণ দেখছি না। বরং যদি কোনো সমস্যা তৈরি হয়, তা মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, এই নীতি শুধু পোশাক খাতের জন্য নয়। বরং যেখানে শ্রমিক কাজ করেন, শ্রম আছে সেসব ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য। কিছু দুর্বল প্রতিষ্ঠানের দায়ভার পুরো শিল্প খাত নিতে পারে না।