![প্রতীক নিয়েও প্রতিযোগিতা](uploads/2023/12/22/1703217814.Eagle_Election.jpg)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এখন দেশব্যাপী চলছে প্রার্থীদের জমজমাট প্রচার। দলের প্রার্থী কিংবা স্বতন্ত্র- সব প্রার্থীই নিজের পাশাপাশি প্রতীকের মাধ্যমেও তার পরিচয়কে ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। প্রতীক নিয়েও চলছে (স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে) প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। ভোটের মাঠে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সর্বাধিক পছন্দ ‘ঈগল’ প্রতীক।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বর্তমানে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪৪টি। ইসির তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার মধ্য থেকে এবার ভোটের মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল। সেখান থেকে দলীয় অন্তর্কোন্দলের কারণে প্রতীক বরাদ্দের আগেই নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়ে গণতন্ত্রী পার্টি (কবুতর)। ফলে ভোটের মাঠে এবার কবুতরের পাখা ঝাপটানো আর দেখা যাবে না। এ ছাড়া বিএনপিসহ তাদের সমমনা ১৫টি রাজনৈতিক দল এবার ভোটে অংশ না নিয়ে নির্বাচনবিরোধী নানা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। সে কারণে ওই সব রাজনৈতিক দলের বাহারি প্রতীকের প্রচার দেখতে পাবে না জনসাধারণ।
নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রতীক নির্ধারিত। তাদের দল মনোনীত প্রার্থী ও জোটের শরিক দলের প্রার্থীরা নির্ধারিত ওই সব প্রতীকে প্রচারে অংশ নেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওই সব প্রতীকের বাইরে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করা কিছু প্রতীক নিয়ে ভোটের প্রচার চালাতে হয়। এ বিষয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, শুধু স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরই প্রতীক বরাদ্দ দিতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সমন্বয় রেখে সংশোধিত নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ২৫টিসহ ৬৯টি প্রতীক সংরক্ষণ করছে নির্বাচন কমিশন। এর আগে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চালুর পর, ২০০৮ সালে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় ১৪১টি প্রতীক সংরক্ষণ করা ছিল। তার মধ্যে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের প্রতীক ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য ছিল ১০২টি প্রতীক।
ভোটে অংশগ্রহণকারী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত ২৫টি প্রতীকের মধ্যে রয়েছে- ঈগল, ট্রাক, রকেট, কলার ছড়ি, কেটলি, তরমুজ, ফুলকপি, মাথাল, মোড়া, ফ্রিজ, সোফা, বাঁশি, ঢেঁকি, কাঁচি, বেলুন, বেঞ্চ, দালান, খাট, ঘণ্টা, তবলা, চার্জার লাইট, সুটকেস, আলমারি, থালা ও দোলনা। এসবের মধ্য থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের পছন্দের প্রতীকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে যদি কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী একই প্রতীক পছন্দ করে আবেদন করেন সেক্ষেত্রে তাদের সমঝোতার মাধ্যমে যেকোনো একজনকে সেটি ছেড়ে দিতে বলা হয়। আর কেউ ছাড় না দিলে লটারির মাধ্যমে তাদের প্রতীক নির্ধারণ করে দেন রিটার্নিং অফিসার।
ইসির চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় ৩০০ আসনের বিপরীতে ভোটযুদ্ধে মাঠে নেমেছেন মোট ১ হাজার ৮৯৫ প্রার্থী। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে রিট করে যারা প্রার্থিতা ফিরে পাবেন তারাও ভোটে অংশ নিতে পারবেন। এদিকে প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে বিএনপিসহ ১৭টি দল অংশ না নেওয়ায় ভোটের মাঠে এবার প্রভাব বিস্তার করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অংগ্রহণকারী মোট প্রার্থীর প্রায় অর্ধেকই স্বতন্ত্র। সংসদীয় ২২১টি আসনে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩৮২ জন। তার মধ্যে ১২৭টি আসনে নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে নামা প্রার্থীদের বেশির ভাগেরই প্রতীক হিসেবে পছন্দ করেছেন ‘ঈগল’। হিসাব করে দেখা গেছে, স্বতন্ত্রদের মধ্যে ১৫২ জনই বেছে নিয়েছেন ঈগল প্রতীক। নির্ধারিত ২৫ প্রতীকের মধ্যে এবার অর্ধেক প্রতীকই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অপছন্দ বা কম পছন্দের তালিকায় রয়েছে। সেগুলো হলো- বাঁশি, ঢেঁকি, কাঁচি, বেলুন, বেঞ্চ, দালান, খাট, ঘণ্টা, তবলা, চার্জার লাইট, সুটকেস, আলমিরা, থালা ও দোলনা।
‘ঈগল’ প্রতীক কেন বেশি পছন্দ- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রার্থীরা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য যেসব প্রতীক রাখা হয়েছে তার বেশির ভাগই মানসম্পন্ন নয়, শুনতে এবং স্লোগানে বলতে ভালো লাগে না। তবে ‘ঈগল’ প্রতীকের মধ্যে একটি ভারিক্কি ব্যাপার রয়েছে। আর সে কারণেই সেটি তারা পছন্দ করেছেন।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন- সেসব হেভিওয়েট আলোচিত প্রার্থীরাই ঈগল প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং আলোচনায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছন ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এ কে আজাদ। ফরিদপুর-১ আসনে আরিফুর রহমান দোলন, ফরিদপুর-২ আসনের অ্যাডভোকেট জামাল হোসেন মিয়া, ফরিদপুর-৪ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
কুমিল্লা-৫ আসনে ঈগল প্রতীক পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী- বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা শওকত মাহমুদ, সাজ্জাদ হোসেন ও আবু জাহের। পরে লটারির মাধ্যমে শওকত মাহমুদকে ঈগল প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। চট্টগ্রাম-১ আসনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৩ আসনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম-১২ আসনেও এবার স্বতন্ত্রভাবে ভোটে ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী।
সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনে মোট ১৭ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন। এর মধ্যে ‘ঈগল’ প্রতীক পেয়েছেন ৭ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে হেভিওয়েট যারা, তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, সরওয়ার হোসেন এবং আহমদ আল কবির। এরা সবাই আওয়ামী লীগেরও নেতা। এ ছাড়া হবিগঞ্জে আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী ও গাজী মোহাম্মদ শাহেদ, সুনামগঞ্জে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও ড. জয়া সেনগুপ্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা।
এদিকে ঢাকা-৫ আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মো. কামরুল হাসান রিপন। সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, নেত্রকোনা-৩ আসনে ঈগল প্রতীক পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মঞ্জুর কাদের কোরাইশী, জামালপুর-৪ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসানও এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে লড়ছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সব আসনে নৌকার সঙ্গে মূল লড়াই হবে ঈগলের।
গত ১৫ নভেম্বর ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক পাওয়ার পর থেকে সারা দেশে চলছে প্রার্থীদের প্রচারকাজ। ভোট প্রার্থনা করে তাদের এই প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। তবে নির্বাচনকে ঘিরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভোটের আগে এবার যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন।