![ভোটের মাঠ : কী করছেন তারা ছয়জন](uploads/2023/12/25/1703484644.voter-math.jpg)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভিড়েও আলোচনায় থাকছেন তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি আর বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতারা। বিএনপি ছেড়ে এসে কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও মাঠে থাকছেন। বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল, অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ ভোটারদের আগ্রহে নির্বাচনের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলছেন তারা। রাজনৈতিক সমীকরণ বলছে, ভোটের ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলবেন ছোট দলের বড় নেতারা।
ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম নেতাদের নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা শোরগোল পড়েছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের পরে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন। রাজনীতিবিদদের বলতে শোনা গেছে, বিএনপি শীর্ষ নেতাদের দলছুট করে নির্বাচনে নিয়ে আসতে নতুন দলগুলোকে লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘ভোটের মাঠে বিশেষ অনুকম্পা ছাড়া আলোচিত ছোটদল বা ‘কিংস পার্টি’গুলোর জিতে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমার মনে হয়, তাদের যদি জিতিয়ে দেওয়া না হয় তবে ভোটের মাধ্যমে জিতে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এদের তৈরি করা হয়েছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে। এদের কোনো বর্তমানও নেই, ভবিষ্যৎও নেই। নীতি-আদর্শবিহীন দলগুলো এখন তাকিয়ে থাকবে আগামী নির্বাচনের দিকে। যদি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দু-একটি আসন পাওয়া যায়।’
নৌকা নেই, জাফর আলম বিরোধীদের ‘সমর্থনে ভরসা’ মুহাম্মদ ইবরাহিমের
বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম হাতঘড়ি প্রতীকে এবার প্রার্থী হয়েছেন কক্সবাজার-১ (পেকুয়া-চকরিয়া) আসনে। বর্তমান সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাফর আলম স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন ঈগল প্রতীকে। ভোটের মাঠে ট্রাক প্রতীক নিয়ে রয়েছেন জাফরপুত্র তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী তুহিন। এর আগে নৌকার টিকিট পেয়েও শেষে ঋণখেলাপের দায়ে ভোটের মাঠ থেকে ছিটকে গেছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ।
ভূমিদস্যুতা, হতদরিদ্র মানুষের ভিটেমাটি জবরদখল, মৎস্যঘের দখলসহ অসংখ্য অভিযোগে আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারিয়েছেন জাফর আলম। চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ তার পক্ষে থাকলেও জেলার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই বিরোধকে কাজে লাগাতে চাইছেন বীর প্রতীক সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।
ঘড়ি প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে থাকা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও আমার পক্ষে কাজ শুরু করেছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। দখলবাজি, শোষণ থেকে বাঁচতে মানুষ আমাকে ভোট দেবে।’
তবে ভোটের মাঠে ছেড়ে কথা বলছেন না জাফর আলম। সৈয়দ ইবরাহিম অভিযোগ করেন, ‘কল্যাণ পার্টির কর্মী-সমর্থকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। নির্বিঘ্নে প্রচারকাজ চালাতে পারছি না।’
ভোটের মাঠে একা, ‘নীরব’ ভোটের আশায় শমসের মবিন
দলীয় প্রতীক সোনালি আঁশ নিয়ে সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসনে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরীর। তার প্রার্থিতার ঘোষণার পর সিলেটের রাজনীতিবিদরা বলেছিলেন, ‘কিংস পার্টি’ তকমায় শমসের মবিনকে আসনটি দেওয়া হলে বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন। তবে এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়ে শমসের মবিন বলেন, ‘আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তৃণমূল বিএনপির কোনো সমঝোতা হয়নি। তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে চায়।’
তবে ভোটের মাঠের চিত্র বলছে শমসের মবিন চৌধুরী কার্যত একা। তার সঙ্গে পরিবার ও এলাকার গুটিকয়েক সদস্য ছাড়া কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সিলেট-৬ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর প্রচার সমন্বয় করা হচ্ছে শমসের মবিনের পরিবার থেকে। প্রচারের দায়িত্বে থাকা শমসের মবিনের ভাই ময়েজ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা একলা মানুষ। কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে প্রচার চলছে। কিছু বিচ্ছিন্ন বাধা পাচ্ছি। তবে এগুলো আমরা সমাধান করছি। অনেক অপপ্রচার চলছে। ইনশাআল্লাহ শমসের মবিন মাঠছাড়া হবেন না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আমরা অবশ্যই নীরব ভোটে জয়ী হব।’
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ‘চিন্তিত’ তৈমূর দেখতে চান শেষ পর্যন্ত
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে ‘আস্থা পাচ্ছেন না’ উল্লেখ করে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ও দলটির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, পরিস্থিতি যা বলছে তাতে রূপগঞ্জে সুষ্ঠু ভোট হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি। বিগত আট দিনের নির্বাচনি প্রচারের চিত্র তুলে ধরে তৈমূর আলম খন্দকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভোটাররা বারবার জানতে চান, তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কি না? মানুষ একটি কথা বলে, ভোট দিতে পারবেন কি না? নাকি তাদের সিল আরেকজন মেরে দেবে।’
সারা দেশে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা ভোটকেন্দ্র দখল করে তাদের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে। সে রিপোর্ট দেখে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে ৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী ছাড়াও তৈমূর আলম খন্দকারকে লড়তে হবে তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী মন্ত্রীপুত্র গাজী গোলাম মর্তুজা (ঈগল), রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান ভূঁইয়া (কেটলি), হাবিবুর রহমানের (আলমারি) সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘মুড়াপাড়া বাজারে আমার পোস্টার ছিঁড়ে নৌকার পোস্টার টানানো হয়েছে। আমার ভোটারদের হুমকি দিয়েছে, বলেছে আমাকে ভোট দিলে গ্যাসসংযোগ কেটে দেবে। চনপাড়া বস্তিতে আমার তিনটা ছেলে মারধরের শিকার হয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে নৌকার লোক ততই অগ্নিমূর্তি ধারণ করছে। যদি বারবার অভিযোগ করতে হয় তাহলে নির্বাচন করব কীভাবে?’
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তৈমূরের অভিযোগ, ‘তারা তো নৌকারই প্রচার করে, তারা মূলত ডামি প্রার্থী। এটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কথা দিয়েছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, সেটার লক্ষণ দেখছি না। তবে আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকব।’
‘শান্তি এক্সপ্রেস’ চালু করবেন মাহি বি চৌধুরী
মহাজোটের শরিক হলেও এবার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পাননি মুন্সীগঞ্জ-১ (শ্রীনগর-সিরাজদীখান) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী। দলীয় প্রতীক কুলা নিয়ে ভোটের মাঠে শামিল মাহির মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসার। পরে আপিল করে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান। মাহি বি চৌধুরীর বিপরীতে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মো. মহিউদ্দিন আহমেদ।
ভোটের মাঠের চিত্র বলছে, এবার মাহির নির্বাচনি প্রচার তেমন গতি পায়নি। আওয়ামী লীগের সমর্থন না থাকায় বিকল্পধারার স্থানীয় কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে গণসংযোগ করছেন তিনি। এলাকায় বেশ কয়েকটি পথসভায় করেছেন মাহি। তবে তাকে নিয়ে ভোটারদের খুব আগ্রহ দেখা যায়নি।
মাহি বি চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ছোট দল, কর্মীও কম। জনসভা, কর্মিসভা কম হওয়াতে এলাকা ঠাণ্ডা থাকে। আমাদের মূল বক্তব্য, শান্তি এক্সপ্রেস চালু হয়েছে এই আসনে। সবাইকে শান্তি এক্সপ্রেসে উঠাতে চাই। রাজনীতিতে চিটা ধুলা-ময়লা উড়িয়ে দিবে কুলা।’
আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব, এগিয়ে মেজর আখতার
কিশোরগঞ্জ-২ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী) আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মো. আখতারুজ্জামান রঞ্জন প্রার্থী হয়েছেন ট্রাক প্রতীকে। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাহার আকন্দ (নৌকা), আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সোহরাব উদ্দিন (ঈগল)।
২০০১ সাল থেকে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে। পর্যায়ক্রমে এম এ মান্নান, সোহরাব উদ্দিন ও সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ নৌকার টিকিট নিয়ে এই আসনে এমপি হয়েছেন। এই আসনে এবার আওয়ামী দুর্গে ফাটল ধরিয়েছেন নূর মোহাম্মদ। দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে তিনি আবদুল কাহার আকন্দ ও সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের তিন নেতার দ্বন্দ্ব আখতারুজ্জামানকে এগিয়ে রাখছে বলে মনে করছেন এলাকার ভোটাররা।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এই আসনের সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান রঞ্জন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার অবস্থান ভালো। সে জন্য আমি নির্বাচনে এসেছি। ট্রাক মার্কা নিয়ে জনগণের সাড়া পাচ্ছি ভালো।’
সুবিধাজনক অবস্থানে শাহজাহান ওমর
বিএনপির দুর্গখ্যাত ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর কাঁঠালিয়া) আসনে দলবদল করে বাংলাদেশ আওয়াম লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হওয়া ব্যারিস্টার এম শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের নৌকার পালে বিজয়ের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ব্যক্তি জনপ্রিয়তা ও রাজাপুর-কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈরিতার নিরসন হওয়ায় বিজয় প্রায় নিশ্চিত হওয়ার আভাস এখন সাধারণ ভোটারদের মুখে মুখে।
ব্যারিস্টার এম শাহজাহান ওমর বলেন, ‘শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় অত্যন্ত সুদক্ষ একজন মানুষ। খালেদা জিয়াও সুদক্ষ ছিলেন, ওনার ভেতরে অলসতা ছিল। ঘুম থেকে উঠতেন ১২টায়, অফিসে আসতেন দেরিতে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভোর ৬টায় উঠে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করেন। আস্তে আস্তে আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত থেকে উন্নতর হব, ভবিষ্যতে আমরা শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ব। যতদিন বাঁচব আপনাদের মাঝে থাকব, আপনাদের সেবা দেব।’
গত ৩০ নভেম্বর নৌকায় মনোনয়ন পাওয়ার পর রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র ঝালকাঠি-২ আসনে বাংলাদেশ আওয়াম লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আমির হোসেন আমুর উদ্যোগে বরিশালে তার বাসভবনে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঝালকাঠি-১ আসনে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও অন্য কোনো প্রার্থীকেই আমলে নিচ্ছে না প্রবীণ এ রাজনৈতিক নেতা। এ কারণে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন তিনি।