![ভোটবিরোধী প্রচার ও ইসির পদক্ষেপে সংশয়](uploads/2023/12/25/1703492545.EC-bnp.jpg)
ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে বিএনপির প্রচারপত্র (লিফলেট) বিলি কর্মসূচি বেআইনি কি না, তা স্পষ্ট নয় বলে মনে করছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবী। একজন নির্বাচন কমিশনার এ কর্মসূচি পালনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও এ বিষয়ে আরও সহনশীল হতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রচারপত্র বিলিকে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্টের চেষ্টা হিসেবে দেখছে।
গত শনিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ভোটারদের নিরুৎসাহিত করতে লিফলেট বিলি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা জানতে গতকাল রবিবার দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজীবী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে খবরের কাগজ। তারা জানান, ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারপত্র বিলি করলে তা আইনের লঙ্ঘন হবে না। তবে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।
গত সপ্তাহ থেকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করার ঘোষণা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করছে বিএনপি। গতকাল আবারও তিন দিনের লিফলেট বিতরণ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় তারা। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অবৈধ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে; নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিএনপির কর্মসূচি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যারা নির্বাচন বর্জন করছে, দেশের জনগণই তাদের বর্জন করতে শুরু করেছে। যারা সন্ত্রাস করছে, তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব আরও সংকুচিত হবে, অনিশ্চয়তা বাড়বে। নেতিবাচক রাজনীতির জন্য সন্ত্রাসের পথ তারা বেছে নিয়েছে। এই সন্ত্রাসের রাজনীতি আর গণতন্ত্র বিপরীতমুখী। যারা সন্ত্রাস করে, তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না।’ ওবায়দুল কাদের গতকাল দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
বিএনপির ভোটদানে নিরুৎসাহিত করে লিফলেট বিলির কর্মসূচির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘ভোটারদের নিরুৎসাহিত করতে লিফলেট বিলি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার তার সবকিছুই করা হবে।’ তিনি গত শনিবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন।
মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘কেউ ভোটে নাও আসতে পারেন, ভোট দিতে নাও পারেন। কিন্তু ভোট প্রতিহত করার অধিকার কারও নেই। আমরা এবার সংশোধনী এনেছি যে ভোট দিতে অন্যকে বাধা দিলে সাত বছর পর্যন্ত জেল বা অর্থদণ্ড হবে। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণ হচ্ছে, এমনটি চোখে পড়লেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট সবাইকে বলেছি যে আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। কোনো কার্পণ্য যাতে না হয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হবে না।’
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (আরপিও) সংশোধনীতে ধারা ৭৭-এর উপধারা ৩-এর (খ) অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যক্তি অসংগত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কোনো ভোটারকে ভোট প্রদান করিতে বা প্রদান করা হইতে বিরত থাকিতে বাধ্য, প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করেন তাহা হইলে সেই ব্যক্তি অসংগত প্রভাব বিস্তারের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন। দোষী ব্যক্তি অনধিক ৭ বছর এবং অন্যূন ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।’
দেশের একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবী মনে করেন, নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়া, অনুরোধ করা বেআইনি নয়। তবে ভোটারদের যদি কোনো ভয়ভীতি দেখানো হয়, ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয় তাহলে সেগুলো বেআইনি হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, মূলত আরপিওতে একটি ধারা আছে, যেখানে কাউকে ভোট দিতে বাধ্য করা বা ভোট দিতে বাধা প্রদান করা যাবে না। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল তাদের ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে যদি লিফলেট বিলি করে সেটা কতটা শাস্তিযোগ্য তা চিন্তা করা উচিত। তা ছাড়া ওই ধারাটি ভোটের দিনের জন্য প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত। এত আগে শুধু লিফলেট বিলির জন্য ওই ধারাটি প্রয়োগ করতে হবে, এমন পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি হয়েছে?
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ইতোমধ্যে একজন (নির্বাচন কমিশনার) বলেছেন লিফলেট বিলি যদি শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আবার আরেকজন বললেন লিফলেট বিলি করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে আমি টোটালি কনফিউজড। আমি মনে করি, আরপিও অনুযায়ী কাউকে জোর করে ভোট দিতে বাধ্য করা বা ভোট দিতে বাধা প্রধান করার বিধানটি ভোটের দিনে প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত।’
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক খবরের কাগজকে বলেন, রাস্তাঘাট বন্ধ করে বা শারীরিকভাবে ভোটদানে বাধা দেওয়া হলে সেটি বেআইনি এবং আইনবহির্ভূত। কিন্তু ভোটে না যেতে উদ্বুদ্ধ করা বাকস্বাধীনতার অংশ। জোর করে বাধা দেওয়া বেআইনি। কিন্তু ভোটে যাবেন না- এই আহ্বান জানানো, অনুরোধ করা এবং যুক্তি দেওয়া বেআইনি নয়।
ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করতে বিএনপির কর্মসূচিকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের চেষ্টা হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তারা মনে করছে, এ কর্মসূচি ভোট প্রদানে বাধা সৃষ্টির প্রাথমিক পদক্ষেপ। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর এ কর্মসূচিকে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্টের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু খবরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনে বাধা দেওয়ার অতীত ইতিহাস আছে বিএনপির। ২০১৪ সালে তারা ভোট বানচাল করতে ভোটকেন্দ্র পুড়িয়েছে। এবারও তারা সেই পথে যেতে পারে। নির্বাচন কমিশনের এগুলো কঠোরভাবে মোকাবিলা করা উচিত।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে না এসে এখন নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের চেষ্টা। আমরা বারবার বলছি, বিএনপি মানুষের রায়কে ভয় পায়। সেটি আবারও প্রমাণ করল বিএনপি।’
লিফলেট বিলির কর্মসূচিকে নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা এ কর্মসূচির গতিবিধি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি) মো. এনামুল হক সাগর গতকাল রাতে খবরের কাগজকে জানান, লিফলেট বিতরণে যদি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে তাহলে পুলিশ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।