![ভোটের খরচে তুঘলকি কাণ্ড!](uploads/2023/12/29/1703825573.Election_Cost.jpg)
ঢাকা-১৯ সংসদীয় আসনের ভোটার সংখ্যা ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৬। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুসারে জনপ্রতি প্রার্থীরা খরচ করতে পারবেন ১০ টাকা হারে। সে হিসাবে প্রার্থীর খরচ হবে ৭৫ লাখ ৬৪ হাজার ১৬০ টাকা। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের গত ১৫ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপন অনুসারে এক প্রার্থী সর্বোচ্চ ব্যয় করতে পারবেন ২৫ লাখ টাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, এই আসনের সচ্ছল প্রার্থীরা এখন কী করবেন! যদি মোট খরচসীমা ২৫ লাখের বেশি না করেন, তবে ভোটারপ্রতি খরচ করা যাবে সর্বোচ্চ ৩ টাকা করে। আবার ১০ টাকা করে খরচ করলে খরচ হয়ে যাবে তিন গুণ বেশি। তবে প্রার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারের সবাই একবাক্যেই বলছেন জনপ্রতি ৩ টাকা বা ১০ টাকা তো দূরের কথা, কয়েক গুণ বেশি খরচ নির্ধারণ করেও খরচের মাত্রা ঠিক করা কঠিন। বিশেষজ্ঞরাও এমনটিই মনে করছেন। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া খরচের সীমা হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। কারণ এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। আবার বেশি খরচ হলেও তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুসারে শাস্তি কী হচ্ছে, সেটিও অনেকেরই জানা নেই।
এদিকে ঢাকা ও অন্যান্য এলাকায় প্রার্থীদের খরচের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাস্তবে গড়ে প্রতিটি পোস্টার ছাপা ও ঝোলানো খরচ ন্যূনতম ১০ টাকা, দৈনিক প্রতিটি মাইক ও প্রচার বাবদ পরিবহন ভাড়া ২ হাজার টাকা এবং প্রতিটি অফিসের ডেকোরেটর আইটেম ভাড়া ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে দৈনিক খরচ ৪ হাজার টাকা পড়ে। সে হিসাবে ৫০ হাজার পোস্টার ছাপা ও ঝোলানো হলেও খরচ বাবদ ৫ লাখ টাকা পড়ে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ২০ দিনে ডেকোরেটর ও অফিস খরচ বাবদ ৮০ হাজার টাকা করে কমপক্ষে ২০টি ক্যাম্প হলেও ১৬ লাখ টাকা, প্রতিটি মাইক ও প্রচার পরিবহন ভাড়া ৪০ হাজার টাকা করে কমপক্ষে ১০টি মাইক হলেও খরচ হয় ৪ লাখ টাকা। এর বাইরে ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিজন এজেন্টের সকাল ও বিকেলের নাশতা, দুপুরের খাবার এবং অন্যান্য দিন কর্মীদের খাবার বাবদ জনপ্রতি খরচ এবং প্রার্থীর জনসংযোগকালে পরিবহন খরচ মিলে কমপক্ষে আরও ১০ লাখ টাকা খরচ হয় বলে ধারণা পাওয়া যায় প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করা খরচের বিষয়টি একটি বিধান। সব প্রার্থীকেই এ বিধান মানতে হবে। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, যারা এখন বলছেন খরচসীমা কম হয়েছে, তারা সব সময়ই এটিই বলবেন। তাদের টাকার অভাব নেই। ফলে খরচসীমা যতই বাড়ানো হোক, ততই তারা বলবেন আরও বাড়ানো দরকার। কিন্তু যাদের টাকা কম, তাদের কাছেই এই ব্যয়সীমাও অনেক বড়।
ঢাকা-১৩ আসনের ভোটার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ খবরের কাগজকে বলেন, ভোটারপ্রতি গড় খরচ ১০ টাকা নির্ধারণের মতো তামাশা এই যুগে আর কিছু হতে পারে না। রাস্তার পাশে চা খেলেও এখন এক কাপ চা কমপক্ষে ৫-১০ টাকা লাগে। এ ছাড়া অন্য সব খরচের গড় হিসাব করলে কী দাঁড়াচ্ছে!’
রাজধানীর কাঁটাবনের আনিশা প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভোটের পোস্টার সবচেয়ে কম খরচে ছাপলেও সাদাকালো ও ৬৫ গ্রামের কাগজে প্রতি পিস গড় খরচ পড়ে ৩ টাকা ৯০ পয়সা। অনেকে আরও ভালো কাগজে পোস্টার ছাপাচ্ছেন, তাতে খরচ স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি পড়ে। কেউ কেউ আবার লেমিনেশন করেন এবং এপিঠ-ওপিঠ ছাপেন আরও বেশি খরচ দিয়ে।’
বরিশালের একটি আসনের নৌকা মার্কার একজন প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচনি এলাকার আয়তন অনুসারে ভালোভাবে প্রচার চালাতে গেলে শুধু পোস্টার ছাপাতেই ৫-৬ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। পোস্টার ঝোলাতে পিসপ্রতি খরচ ছাপার দ্বিগুণ। কারণ সেখানে রশি কিনতে হয়, আঠা লাগে, মই লাগে, পরিশ্রমও বেশি লাগে। এখন আর দলের কর্মীরাও বিনা পয়সায় কাজ করতে চান না। এমনকি পয়সা দিয়েও অনেক সময় লোক পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।’
খুলনার আরেক প্রার্থী বলেন, পোস্টার ছাড়াও নির্বাচনি অফিসের জন্য দৈনিক হিসাবে চেয়ার-টেবিল, শামিয়ানা, বাঁশের ভাড়া গুনতে হয়। পাকা অফিস ভাড়া নিলেও সেখানেও মোটা অঙ্কের ভাড়া দিতে হয়। যাতায়াতে অনেক খরচ যায়। মাইকের প্রচারে প্রতি মাইকের জন্য ১ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। কোনো অবস্থায় ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা কোনো প্রার্থীর পক্ষে ২৫-৩০ লাখ টাকায় ভোট করা সম্ভব না। এটা অবশ্যই দ্বিগুণ করা উচিত বা উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম-৮ বোয়ালখালী-চাঁন্দগাঁও আসনের লাঙ্গল প্রতীকের জোট প্রার্থী সোলাইমান আলম শেঠ গতকাল অতিরিক্ত টাকা খরচের বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচনের বিধি মেনেই খরচ করছি। সেটা তো বিস্তারিত মিডিয়ায় বলা যাবে না। আজও আমার পাঁচটি গাড়ি নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় প্রচারকাজ চালানো হয়েছে।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনি বিধিবিধান মেনেই অফিস ভাড়া, কর্মীদের খরচ দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে প্রার্থীরা প্রতি ভোটার হিসেবে লিফলেট, ভোটের দিন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভোটার কার্ড, পোস্টার ছাপাচ্ছেন; যা প্রতিটি লিফলেট ও ভোটার কার্ডে ১ টাকা করে খরচ হচ্ছে, পোস্টারে খরচ হচ্ছে ৯ টাকা। এতেও অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে।
সিলেট নগরীর পার্বণ ডেকোরেটর্সের পরিচালক কার্তিক পাল জানান, একটি নির্বাচনি আড়াই ফুট উচ্চতার মঞ্চ বানাতে খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। জায়গাভেদে খরচ বাড়তে পারে। ইনডোর মঞ্চ ১৫ হাজার টাকা। মাইকিংয়ের খরচ প্রতিদিন প্রতিটি মাইক ভাড়া ১ হাজার টাকা। সিএনজি ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ২০০ টাকা, রিকশা ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ১০০ টাকা, ক্যানভাসার প্রতি ঘণ্টা ২০০ টাকা করে মজুরি নেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনি অফিস খরচ প্রতিদিন ১ থেকে ২ হাজার টাকা হয়।
রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটি আসনের দুজন প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক জানান, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও লিফলেট তৈরিতেই প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। এ ছাড়া মাইক ও অটো বা ভ্যান ভাড়া এবং সঙ্গে দুজন লোককে দিয়ে প্রচার-প্রচারণাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ হবে। আবার গণসংযোগের পাশাপাশি নির্বাচনি এলাকায় প্রতিদিনই মতবিনিময় সভা, পথসভা, উঠান বৈঠক ও জনসভার আয়োজন করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্যান্ডেল তৈরি, ডেকোরেটর ভাড়া, আপ্যায়নসহ একেক স্থানেই প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের দেড় থেকে ২০০টি নির্বাচনি অফিস রয়েছে। প্রতিটি অফিসকে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়।
রাজশাহী নগরীর আলুপট্টির বাংলাদেশ মাইক সার্ভিস নামে ওই দোকানের মালিক ওয়াহিদুর রহমান রুমেল বলেন, ‘রাজশাহীতে প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনেই তার মাইক ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ভাড়া নিয়েছেন প্রায় সবাই। একেকজন প্রার্থী চার-পাঁচটা করে মাইক ভাড়া নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে মাইকপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা রয়েছে।
খুলনা নগরীর কেডি ঘোষ রোডের মাইকের দোকান বিপ্লব সাউন্ডের মালিক নজরুল ইসলাম বিপ্লব জানান, প্রতিদিন তার দোকান থেকে গড়ে ২০-২৫টি মাইক ভাড়া যায়। একটি মাইকের প্রতিদিনের ভাড়া ৫০০ টাকা। তবে নির্বাচন পর্যন্ত যদি কেউ টানা মাইক ভাড়া নেন, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।’
সিটি ডেকোরেটরের মালিক জাহিদুল ইসলাম বাবু জানান, বিভিন্ন স্থানে প্রচার ক্যাম্প করার জন্য ডেকোরেটরের মালামাল ভাড়া নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আলাদাভাবে চেয়ার-টেবিল ভাড়া দেওয়া হয়। গড়ে একটি প্রচার ক্যাম্পে প্রতিদিন ডেকোরেটর খরচ ৫০০-৭০০ টাকা।
খুলনা-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি দুই দিন ধরে প্রচার শুরু করেছি। এখনো পোস্টার-লিফলেট প্রয়োজন অনুসারে ছাপাতে পারিনি। সব এলাকায় কর্মীও দেওয়া হয়নি। তাতে প্রতিদিন ৩৫-৪০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। নির্বাচনের আগে প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হবে ধারণা করছি।’
খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুস সালাম মুর্শেদীর সহকারী এজেন্ট মো. মোতালেব হোসেন বলেন, নির্বাচনি এলাকা রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া উপজেলার নৌকা প্রতীকের ১৩৩টি ক্যাম্পে প্রতিদিনের খরচ গড়ে ৫০০ টাকা হিসাবে মোট ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো আসনে ভোটার সংখ্যার আধিক্য থাকলেও কোনো প্রার্থীর মোট ব্যয় ২৫ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না। এমনকি কোনো প্রার্থী দল থেকে কোনো অনুদান পেলেও সেটিসহ তার সর্বোচ্চ ব্যয় এর বেশি হতে পারবে না।
আইন অনুযায়ী, প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে ভোটের আগ পর্যন্ত যে সময়, সেই সময়ে ব্যয় করা অর্থকে একজন প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত সব প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব ইসিতে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। যদি কোনো প্রার্থী তা জমা না দেন, তার বিরুদ্ধে মামলা করা ও শাস্তির বিধান (৬ মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা) রয়েছে।
একইভাবে ভোটে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও আসনভিত্তিক প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় ইসির নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করা আছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলগুলো সেই নির্বাচনি ব্যয় হলো- কোনো দল ৫০ জন প্রার্থী দিলে ব্যয় করতে পারবে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা। ৫১ থেকে ১০০ প্রার্থী দিলে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১০১ থেকে ২০০ প্রার্থীর জন্য ওই দলের নির্বাচনি ব্যয় ৩ কোটি টাকা এবং ২০০-এর বেশি প্রার্থী দিলে ওই দল সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৪৪ ধারা অনুযায়ী, ভোটের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের পর ৯০ দিনের মধ্যে দলগুলোকে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেটা অমান্য করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যথাসময়ে তার দলের ব্যয়ের হিসাব না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছিল।
এর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থীদের ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্বাচনি ব্যয় ছিল। তবে দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয় ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ভোটারপ্রতি ব্যয় বেঁধে দেওয়া হয়। আর নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটার প্রতি ৫ টাকা, প্রার্থীর সর্বোচ্চ নির্বাচনি ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা।
এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন উজ্জ্বল মেহেদী (সিলেট ব্যুরো), আব্দুস সাত্তার (চট্টগ্রাম), এনায়েত করিম (রাজশাহী), মাকসুদ রহমান ( খুলনা)