ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে আগামী ৬ ও ৭ জানুয়ারি দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা করলেও দলটি সংঘাতের পথে যাবে না। তবে মিছিল-পিকেটিং করে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে। উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায়।
২০১৪ সালে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও এবার নির্বাচন বর্জন করে মানুষকে ভোট দিতে না যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে বিএনপি। নির্বাচন যাতে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য না হয়, এমন পরিস্থিতি তৈরি করাই এবার বিএনপির উদ্দেশ্য। হরতাল কর্মসূচি থাকলে জনগণ ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হবে বলেও মনে করে দলটি। এ কারণে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন হরতালের ডাক দিয়েছে দলটি।
বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি জানান, শনিবার (৬ জানুয়ারি) সকাল ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করবেন তারা।
তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন কিংবা এর পরেও সংঘাতের রাজনীতিতে না জড়াতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই যেন কেউ সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ান। এ কারণে কঠোর অবস্থান বা সংঘাতপূর্ণ কর্মকাণ্ডেও তারা জড়াবেন না। অর্থাৎ নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য বিএনপি ও সমমনা দলগুলো মাঠে নামবে না।
সূত্রমতে, বিএনপির পক্ষ থেকে সমমনা দল, জোট ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকেও দলের পক্ষ থেকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। এতে করে নির্বাচনের আগে ও পরে শান্তিপূর্ণ অবস্থানই বহাল রাখবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি কখনোই সন্ত্রাসের রাজনীতি করে না। বিভিন্ন অগ্নি-সন্ত্রাসে অহেতুকভাবে বিএনপিকে জড়িয়ে সরকারি দল যা বলছে তা স্রেফ প্রোপাগান্ডা। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে ঘটনার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত থাকলেও ক্ষমতাসীনরা বিএনপির বিরুদ্ধেই এসব অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। এটা আমাদের নেতিবাচকভাবে ব্র্যান্ডিং করার অপকৌশল।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণভাবেই আমরা নির্বাচন বর্জনের চেষ্টা করব।’
এদিকে আগামী ৬ ও ৭ জানুয়ারি সারা দেশে হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও আজ শুক্রবার গণসংযোগ ও মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। দলটির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি দল হোক আর প্রশাসন হোক, তাদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার নির্দেশনা পেয়েছেন তারা। সবশেষ দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক ও বিভাগীয়-জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকেও শান্তিপূর্ণভাবে সব কর্মসূচি পালনের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল খবরের কাগজকে জানান, লিফলেট বিতরণের মতোই বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি পালন করবে। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে আমরা ভোটকেন্দ্রে না যেতে এবং নির্বাচনকে না বলতে বলেছি। তিনি বলেন, হরতালে আগেও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা বরাবরের মতোই শান্তিপূর্ণভাবে মাঠে থাকব। আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছি। একতরফা নির্বাচন জনগণ বর্জন করেছে। তারা ভোটকেন্দ্রে যাবে না।’
কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর্মসূচি নিয়ে আমরা কাল বসব। মানসিকভাবে আমরা প্রস্তুত আছি। সাধ্যমতো চেষ্টা করব ঝামেলা-সংঘাত এড়িয়ে কর্মসূচি পালন করার। কিন্তু এটার জন্য উভয়পক্ষ থেকে একই মনোভাব থাকা দরকার। লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতেও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই আমরা মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি।’
এবারের হরতাল কর্মসূচিকে ঘিরে যাতে ‘তৃতীয় পক্ষ’নাশকতা ঘটাতে না পারে, সে জন্য সতর্ক অবস্থানে থেকে কর্মসূচি পালনে সচেষ্ট থাকবে বিএনপি।
নেতাদের মতে, কর্মসূচিকে ঘিরে অঘটন ঘটিয়ে এর দায়ভার বিএনপির ওপর দেওয়া হবে। আর এটিকে হাতিয়ার বানিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নতুন করে মামলা ও গ্রেপ্তারের সুযোগ নিতে চাইবে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আমাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সরকারি দলের কোনো উস্কানিতে আমরা পা দেব না।’
এদিকে ৬ জানুয়ারি ভোর ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। বৃহস্পতিবার দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম এক বিবৃতিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
হরতাল প্রসঙ্গে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ ও অহিংসভাবে কর্মসূচি পালনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। জামায়াত গণতান্ত্রিক দল কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আমরা বিশ্বাস করি না। ফলে ৭ জানুয়ারি হরতালের দিনও আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই কর্মসূচি পালন করব।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল ও ১২ দফায় ২৪ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে বিএনপি। এরপর ভোট ঠেকাতে জনগণকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষকে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে সারা দেশে ১২ দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি।