দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সারা দেশে ভোটের উৎসব চলছে। ভোটের গরম হাওয়া এখন নির্বাচনি মাঠে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বেগবান হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাড়ছে লেনদেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা- প্রধান দুটি উৎসবের পরই ব্যাপকভাবে অর্থের লেনদেন ঘটে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। পাঁচ বছর পর আবারও উৎসবমুখর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।
এই নির্বাচন কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে লেনদেন হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। এতে অর্থনীতিতে সাময়িক প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। ফলে অর্থনৈতিক খাতে মন্দাভাব থাকলেও নির্বাচনি ব্যয়ের কারণে কিছুটা গরম হয়ে উঠেছে।
এবারের নির্বাচনে কত টাকা লেনদেন হতে পারে? তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এটি নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা গবেষণা বা জরিপ করেনি। তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। এই নির্দেশ কাগজে-কলমে থাকলেও নির্ধারিত সীমার চেয়ে যে বহুগুণ খরচ হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসি বলেছে, নির্বাচনের আগে অজ্ঞাত পরিমাণ অর্থ ব্যয় বন্ধ করাই ব্যয়সীমা বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্য। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রচারে প্রার্থী ইসির বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে ব্যয় করা হচ্ছে কি না, তা দেখার বা তদারকি করার কেউ নেই। ফলে নির্ধারিত ব্যয়ের যে সীমা দেওয়া হয়েছে, তা শুধু কাগজে-কলমেই।
ঢাকা-৪ আসনের নৌকার মনোনীত প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম খবরের কাগজ বলেন, ইসির আইনকানুন মেনেই নির্বাচনে খরচ করছেন তিনি। ব্যয়ের বেশির ভাগ টাকা প্রচারকাজে যায় বলে জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে মোট ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এর বড় একটি জোগান এসেছে নির্বাচন কমিশনের বাজেট থেকে। এই টাকা অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে। এই টাকার বড় একটি অংশ ব্যয় হয়েছে নির্বাচনি প্রচারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোস্টার ছাপানো, নির্বাচনি ক্যাম্প তৈরি, প্রিন্টিং খরচ, ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি ইত্যাদি। নির্বাচনের সময় এসব খাতে অর্থের লেনদেন বেড়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হয়। এ ছাড়া খাওয়া-দাওয়া, বিড়ি-সিগারেট ব্যয়ের একটি বড় খাত।
রাজনৈতিক দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছু ব্যয় আছে অদৃশ্য। এর অঙ্ক খুব একটা ছোট নয়। তবে এই ব্যয় তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব একটি কাজে আসে না। জানা যায়, এবারের নির্বাচনে ইসির বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্য স্থির করেছে ইসি। ইসি যে বাজেট করেছে, তার বেশির ভাগ খরচ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে। এ ছাড়া প্রার্থীদের নিজেদের বাজেটও আছে। প্রতি আসনে ২ কোটি টাকার কম নয়। রাজনৈতিক দলীয় সূত্র বলেছে, যারা হেভিওয়েট প্রার্থী তাদের বেলায় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সবকিছু মিলে সারা দেশে ৩০০ আসনে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হলে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় না। তবে কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। চা, বিড়ি-সিগারেটের বিক্রি বেড়েছে। প্রিন্টিং ব্যবসা চাঙা হয়েছে। পোস্টার ছাপানোর জন্য চাহিদা বেড়েছে কাগজের। কিছু লোকের হাতে টাকা যাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের লোকদের কাছে। ফলে ছোট একটি প্রভাব পড়ছে। এসবের ফলে একধরনের প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে অর্থনীতিতে।
যোগাযোগ করা হলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, এবারের নির্বাচনে যে লেনদেন হচ্ছে তাতে অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে প্রতিযোগিতা বাড়ে। তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হয়। কিন্তু এবার সে রকম কর্মচাঞ্চল্য নেই। তবে কিছু প্রভাব তো পড়বেই। আমি মনে করি, নির্বাচনে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে। এই টাকা অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা নানা উপায়ে খরচ করে থাকেন। এর ফলে রাজস্ব আয় বাড়ে। পোস্টার ছাপানোর ওপর ভ্যাট আছে। ভ্যাট আদায় বাড়বে। বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বাড়লে রাজস্ব আয় বাড়ে। তিনি মনে করেন, নির্বাচনে কিছু অনৈতিক লেনদেনও হয়। এই টাকা অর্থনীতির মূলধারায় আসে না।
তিনি আরও জানান, যাদের কাছে টাকা আছে তাদের টাকা কিছুটা হস্তান্তরিত হয়। শুনলাম একজন প্রার্থী যাতে না দাঁড়ান সেই শর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছেন। এটি অনৈতিক। এই টাকা অর্থনীতির মূলধারায় আসেনি। অর্থনীতি ধারণ করতে পারেনি। অনৈতিক লেনদেন অর্থনীতি কখনোই স্বীকার করে না। নির্বাচনে যেটি হয়, তা হচ্ছে ধনীর কিছু টাকা গরিবের কাছে যায়। এর ফলে গরিব লোকজন সাময়িকভাবে উপকৃত হন।
ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনি কাজ পরিচালনা করতে বেশ কয়েক ধরনের সরঞ্জাম কেনে ইসি। যেমন- ব্যালট পেপার, স্ট্যাম্প প্যাড, মনোনয়ন ফরম, অফিশিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাশ সিল, অমোচনীয় কালির দাগ, চটের ব্যাগ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, বাক্সের লক ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রার্থীর ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্প, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা সংস্থার ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খাতে নির্বাচনি বাজেট বরাদ্দ থাকে। নির্বাচন ঘিরে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাবই লক্ষ করা যায়।
এরই মধ্যে নির্বাচন ঘিরে ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট। বিলাসবহুল শপিংমল, হোটেল, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চায়ের দোকানের আড্ডায়ও চলেছে নির্বাচনি প্রচার।