![বাংলা ভাষার বিকৃতিরোধে জরুরি নীতিমালা দরকার](uploads/2024/02/24/1708756496.Bangla_Language.jpg)
মায়ের মুখ থেকে শেখা যে বুলি, যার মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করি মনের ভাব, সেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি ও বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা প্রাণ দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালে। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য এমন জীবনদান বিশ্বের বুকে বিরল। তাই সেই ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়। এই বাংলার নামের সঙ্গে মিল রেখেই এ দেশের নাম বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাভাষা একদিকে যেমন বাংলাদেশের পরিচায়ক তেমনি এই জাতির অহংকারও। কিন্তু যে ভাষাকে রক্ষার জন্য একদিন প্রাণ দিয়েছিল বাঙালি, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পেরোতে না পেরোতে সেই বাংলা ভাষাই এখন নিজ দেশে নানাভাবে বিকৃতির শিকার হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভাষা প্রবহমান নদীর মতো। এক জায়গায় স্থির থাকে না। ভাষার পরিবর্তন হবে এবং এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সে পরিবর্তন ইতিবাচক হলে ভালো, আর তা না হলে ভাষা নিজস্বতা হারায়। যে অবস্থায় এখন ভুগছে আমাদের বাংলা ভাষা।
ভাষার নামেই যে দেশের নাম, আজ সেখানেই ভাষাকে সম্মান দেওয়ার জন্য নতুন করে লড়াই করতে হচ্ছে। ভাষার অসম্মানের প্রতি নজর নেই কারও। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় কাজ চলছে। বিদেশের সঙ্গে বা বিদেশিদের সঙ্গে অবশ্যই ইংরেজিতে যোগাযোগ হবে। বিশেষ প্রয়োজনে তা হতেই পারে। কিন্তু এখনো কেবল ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার হয় অনেক প্রতিষ্ঠানে। সরকারি আদেশ অমান্য করে দোকান-রেস্তোরাঁর নামও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। এমনকি পত্রিকা এবং টেলিভিশনের মতো মূল ধারার গণমাধ্যমেও হচ্ছে বাংলা ভাষার এই মিশ্র ও বিকৃত ব্যবহার। আর অনলাইন পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা বেশ প্রভাব বিস্তার করেন (সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার) তারাও অবাধে বাংলার মিশ্র ও বিকৃত ব্যবহার করছেন। এবং এখানে প্রমিত বাংলার ব্যবহারে তেমন কোনো তদারকিও নেই। যদিও বেতার ও টিভিতে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণরোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। তবে নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়ন খুব একটা হয়নি।
এ বিষয়ে রেডিও স্বাধীনের অনুষ্ঠান প্রধান শাকিল আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা বাংলা একাডেমি এবং রবি ঠাকুরের বইগুলোকে অনুসরণ করি। নতুন কেউ আমাদের এখানে উপস্থাপনার জন্য এলে আমরা তাদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেই, তারা যেন যখন বাংলা বলবেন তখন পুরো বাক্যটি বাংলায় বলেন এবং যখন ইংরেজিতে বলবেন, তখন পুরো বাক্যটি ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হই, তা হলো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই পরিবার-স্কুল থেকে যেভাবে শেখে, তাতে দেখা যায় তারা মিশ্র ভাষায় কথা বলছে এবং তাদের উচ্চারণেও ভিন্নতা থাকে। এখন কথা হচ্ছে, যে মানুষটি বড়ই হয়েছে ওভাবে কথা বলে এবং যে জানে না প্রমিত বাংলার উচ্চারণ, তাকে আমরা কতটা পরিবর্তন করতে পারি? আর যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে তার নিজস্বতা ও কথার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়।’
ভাষা বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদিন প্রতিক্ষণে মিশ্র ভাষায় কথা বলে ভাষাকে দূষিত করছে খোদ বাংলাদেশের মানুষই। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। আজকের তরুণ সমাজ কথা বলার সময় বাংলার ভেতরে অবলীলায় অহেতুক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যেমন- অ্যান্ড, বাট, সো, অলসো, অলদো, অ্যাকচুয়ালি ইত্যাদি শব্দ। অথচ এগুলোর সুন্দর, সাবলীল বাংলা শব্দ রয়েছে। শুধু তরুণরাই নয়, সব বয়সী মানুষের মধ্যেই এইভাবে কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়। যেন বাংলার মধ্যে একটু-আধটু ইংরেজি না বললে জাতে ওঠা যায় না। আবার অনেকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে এক-দুটি বাক্য ইংরেজিতে বলে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে চান।’ - বলছেন ভাষা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘কিন্তু যখন তারা ইংরেজি বলছে, তার মধ্যে তো দু-একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার হচ্ছে না যেহেতু ভাষা পরিবর্তনশীল, তাই এমনিতেই বাংলায় অনিবার্যভাবে বিদেশি অনেক ভাষার ব্যবহার হয়েছে ও হচ্ছে। যেমন- ইন্টারনেট, মোবাইল, টিভি, ওভেন, ফ্রিজ- এ রকম শব্দগুলো এখন যেন বাংলা ভাষারই অংশ।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান খবরের কাগজকে বলেন, “সব ভাষার মধ্যেই মিশ্রণ ঘটে। বাংলা ভাষার মধ্যে শুরু থেকেই আরবি, ফারসি ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার অনেক শব্দের ব্যবহার আছে। যেগুলো হয়তো আমরা জানিও না। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বাংলা বলতে গিয়ে একটি বাক্যের মধ্যে অহেতুক একটি-দুটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। যেমন- কেউ একজন বলছেন, ‘আজ আমার কিছু ফ্রেন্ডসকে বাসায় ইনভাইট করেছি।’ কিন্তু এখানে যে দুটো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর খুব সুন্দর সহজ প্রচলিত বাংলা রয়েছে যা হলো, ‘ফ্রেন্ডস=বন্ধু ও ইনভাইট=দাওয়াত বা নিমন্ত্রণ’। ভাষার এ ধরনের ব্যবহারে বাংলা ভাষা তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকৃতির শিকার হচ্ছে।”
ভাষা বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, কিছু মানুষ আছেন যারা ইংরেজির দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকছেন। বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন তারা। বাচ্চাদের রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম, পায়েস- সব কিছুকেই সুইট বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বাংলার বৈচিত্র্য সন্তানদের শেখাচ্ছেন না। এমনকি বাংলার ইতিহাসও তারা জানান না। বাংলাকে পুরোপুরি অবহেলা করে চলেছেন। এই দল বাংলা ভাষার জন্য প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিকর। আরেক দল আছেন, যাদের বাচ্চারা হিন্দি চ্যানেল দেখে দেখে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করেছে। আবার তারা নিজেরাও বাচ্চাদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেন। আবার অনেকে মিশ্র বাংলায় কথা বলেন। ফলে শিশুটি ছোট থেকেই মিশ্র ভাষাকে সঠিক ভাষা হিসেবে শিখে বড় হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রমিত বাংলা যে বলতে পারেন তাকে আমরা কী কোনো আলাদা বা বিশেষ সম্মান দিচ্ছি? প্রশ্ন করে রেডিও স্বাধীনের অনুষ্ঠানপ্রধান শাকিল আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যদি প্রমিত বাংলায় কথা বলে তাকে উৎসাহিত করি এবং কাজের জায়গায় যখন মূল্যায়ন করি, তাকে বিশেষ নম্বর দিয়ে এগিয়ে রাখি তাহলে মানুষ প্রমিত বাংলা শিখতে আগ্রহী হবেন এবং ব্যবহার করবেন। কিন্তু আমরা অফিসে দেখি, যে মানুষটি ইংরেজিতে ভালো প্রেজেন্টেশন দিতে পারেন তাকেই আমরা এগিয়ে রাখি। ফলে মা-বাবারাই এখন আর সন্তানকে প্রমিত বাংলা শেখান না। এ কারণেই প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে প্রমিত বাংলার ব্যবহার। বিসিএস বা এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর মার্কিংয়ে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের ওপর আলাদা নম্বর রাখা এখন সময়ের দাবি। তাহলে এর চর্চা আরও বাড়বে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেশি হওয়া উচিত। বিশেষ করে আদালত, প্রশাসনে এর ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলা ভাষার গঠন কাঠামো আরও সহজ করতে হবে। কারণ ভাষা যারা ব্যবহার করেন, তারা নিজের সুবিধাটি সবার আগে বোঝেন। তাই যেভাবে তিনি সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন, সেটিই করবেন। এ ছাড়া গণমাধ্যম যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ভাষা শেখার জন্য, তাই পত্রিকা এবং টিভিসহ অন্যান্য মাধ্যমের জন্যও কীভাবে তারা উচ্চারণ করবেন এবং কীভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার করবেন তার একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। তবে সেটিও গণমানুষের জন্য যেন সহজ হয়, বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’