![এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে পদ্মা](uploads/2024/03/15/1710479809.Exam_Padma-Bank.jpg)
দেশে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) একীভূত হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। এতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সায় রয়েছে বলে জানা গেছে। সরকার মূলত এই মার্জারকে পাইলট বা পরীক্ষামূলক হিসেবে দেখতে চায়। এই মার্জারে সাফল্য পাওয়া গেলে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করা হবে।
এদিকে পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত করতে প্রাথমিকভাবে একটি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) স্বাক্ষর করা হবে আগামী সোমবার (১৮ মার্চ)। বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বাক্ষর হতে যাওয়া ওই অনুষ্ঠানে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। এমওইউ স্বাক্ষর করবেন আলোচিত দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও)। উপস্থিত থাকবেন এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ চেয়ারম্যান যথাক্রমে নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং মো. আফজাল করিম।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আফজাল করিম সাংবাদিকদের গতকাল বলেন, ‘এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে, যা এখনই বিস্তারিত বলা যাবে না।’
গত ৩১ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংক থেকে সরে যেতে হয় ছয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। এরপর বৃহৎ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমডি ও সিইও মো. আফজাল করিম পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান।
গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে এক্সিম ব্যাংক পর্ষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা লিখিত চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছি। আগামী সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে এমওইউ স্বাক্ষর হবে।’ এটি মার্জার না অধিগ্রহণ- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মার্জার করছি। দুই ব্যাংকের ইচ্ছানুসারেই এটি হচ্ছে। আর এ কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শ এবং দুই ব্যাংকের আইনজীবী মিলে ঠিক করে নিবেন।’
পদ্মা ব্যাংক থাকছে না
শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে প্রথাগত সুদ আয় করা ব্যাংকের মার্জার হলে আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আস্থা দুটোই বেড়েছে। এতে পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। এক্সিম ব্যাংকেও কোনো সমস্যা হবে না।’
মার্জার হলে নতুন নাম হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর দরকার হবে না। কারণ মার্জারের পর আর পদ্মা ব্যাংক থাকছে না। পুরোটাই এক্সিম ব্যাংকের শরীয়াহ ব্যাংকিংয়ের আওতায় চলে আসবে।’
দুই ধারার ব্যাংকেও মার্জার হয়
বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে সিনিয়র ব্যাংকার এবং সাবেক এনসিসি ব্যাংকের এমডি ও সিইও নুরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুটি দুই ধারার ব্যাংক হলেও মার্জার হতে পারে। কিন্তু সম্পদের চূড়ান্ত হস্তান্তরের আগে পদ্মা ব্যাংককে শরীয়াহ ঘোষণা করে নিজেদের পর্ষদে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। তা না হলে এই মার্জার আইনসিদ্ধ হবে না। গ্রাহক, আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হবে না। এখানে প্রশ্ন হলো, একটি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের আমানতকারী, শেয়ারহোল্ডার ও সাধারণ গ্রাহক সুদের আয় মেনে নিবে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী এটি হওয়ার নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন করে নীতিমালা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংক মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গত মঙ্গলবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে ‘প্রম্প কারেকটিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ওইসব ব্যাংক নিজেদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে স্বেচ্ছায় মার্জার করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগত বৈধতা দিতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা ও অনুমোদন দেবে। তবে এক্ষেত্রে একটি থার্ড পার্টি অডিটের মাধ্যমে সম্পদ মূল্যায়ন করার পর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। এটি রাতারাতি হবে না, এ জন্য সময় লাগবে। ডিসেম্বরের মধ্যে যদি কোনো দুর্বল ব্যাংক স্বেচ্ছায় মার্জারে যেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে মার্জার করে দেবে।
একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকের মন্দ ঋণ কিনতে আইন হচ্ছে
নিয়ম অনুযায়ী একীভূত হওয়া দুর্বল ব্যাংকের মন্দ ঋণ কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। এ জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে বলে গত সপ্তাহে জানিয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এ ব্যবস্থার ফলে মার্জার হতে অংশীদার বা পিয়ার ব্যাংকের দুর্বল সঙ্গী নিয়ে কোনো দায় থাকবে না।’
উল্লেখ্য, পদ্মা ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬৩ দশমিক ৫০ শতাংশ সম্পদ বর্তমানে খেলাপি হয়ে আছে। এর পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। সংকটে পতিত এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি মেটাতে দরকার ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির স্থিতিশীল সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
২০১৩ সালে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটলে ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আসে এবং নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ২০১৭ সালে এ ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি একাধিক ব্যাংক ও সংস্থা। অন্যদিকে ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক মুনাফা আয়ের লক্ষ্য নিয়ে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০৪ সালে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বৃহস্পতিবার ১৪ মার্চ শেয়ারবাজারে এই ব্যাংকের প্রতি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০ টাকা। ব্যাংকটির শেয়ারের দাম এদিন ১ শতাংশের মতো বেড়েছে। ওয়েবসাইটে রাখা আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকটিতে আমানতকারীদের অর্থ আছে ৪২ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। একটি সবল ব্যাংক হিসেবে পরিচিত এ ব্যাংক ২০২৩ সালে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ২৭ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি ব্যবসা করেছে। ২০২২ সালে এ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা।